
চাহিদার চেয়ে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা, অথচ জ্বালানি সংকটে চালানো যাচ্ছে না সাশ্রয়ী কেন্দ্রগুলো। একদিকে বসিয়ে রেখেই বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে দিতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’, অন্যদিকে চড়া দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে মেটাতে হচ্ছে ঘাটতি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই আর্থিক রক্তক্ষরণ বন্ধে কাঠামোগত কোনো সংস্কার আনতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। ৭০ হাজার কোটি টাকার বকেয়া পরিশোধ এবং কিছু আইনগত পরিবর্তন ছাড়া টেকসই কোনো রূপরেখা তৈরি না হওয়ায় এই খাতটি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য এক বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ আছে, জ্বালানি নেই
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১,৩২০ মেগাওয়াটের নতুন একটি কেন্দ্র উৎপাদনে আসায় দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াট। অথচ সর্বোচ্চ চাহিদার সময়েও বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়েছে ১৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। ফলে অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।
অন্যদিকে, দেশে দৈনিক প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সংকটের কারণে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাট ও খুলনার রূপসার মতো সাশ্রয়ী ও উচ্চ কার্যক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো যাচ্ছে না। ফলে একদিকে অব্যবহৃত থাকছে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, অন্যদিকে বিদ্যুৎ না নিয়েই সরকারকে গুনতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ।
এক বছরের পদক্ষেপ: ঋণ পরিশোধ আর ছোটখাটো সাশ্রয়
অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বকেয়া দেনা পরিশোধ করেছে। পাশাপাশি, ব্যাপক বিতর্কিত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ বাতিল করে প্রশংসিত হয়েছে।
এ ছাড়া, কয়েকটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা এবং ট্যারিফ কমিয়ে আনার মাধ্যমে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের দাবি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। গত অর্থবছরে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিলেও চলতি অর্থবছরের জন্য তা কমিয়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পদক্ষেপ মূল সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। আর্থিক ক্ষত তৈরি করা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলো পর্যালোচনা বা বাতিলের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা কমানোর বিষয়েও কোনো বড় সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সরকার।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, “বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে একটি আলাদা সংস্কার কমিটি করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সরকার তা করতে পারেনি। সরকারের শ্বেতপত্রে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো খুবই সাধারণ। ব্যয় সংকোচন ও দুর্নীতির বিষয়গুলো যথাযথভাবে উঠে না আসায় আগের সরকারের ধারাবাহিকতাতেই সব চলছে।”
মূল সংকট যেখানে ছিল সেখানেই
বিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত সক্ষমতা তৈরি করায় গত দেড় দশকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের সময়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হওয়া চুক্তিগুলোর কারণেই এই বিশাল দায় তৈরি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার আদানিসহ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনার জন্য কমিটি গঠন করলেও তা এখনও আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু মনে করেন, সংস্কারের প্রথম ধাপ হওয়া উচিত ছিল পূর্ববর্তী সরকারের চুক্তিগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুর্নীতির খাত ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। বিশেষ আইনে করা চুক্তিতে কী ছিল, তা উন্মুক্ত করা এ সরকারের প্রধান কাজ ছিল। কিন্তু তা তারা করতে পারেনি। বিপুল দায়দেনা পরিশোধের আগে দরকষাকষি করা দরকার ছিল।”
এদিকে, গ্যাস খাতে স্থানীয় অনুসন্ধানকে অবহেলা করে এলএনজি আমদানির ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। গত দুই দশকে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে এলএনজি আমদানিতেই ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা।
সরকারি ভাষ্য ও ভবিষ্যৎ
সরকার বলছে, বিদ্যুৎ খাতের মৌলিক সংস্কার শুরু হয়েছে এবং এর কার্যক্রম চলছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “বিশেষ আইন বাতিল হওয়ায় এখন আর এককভাবে কাজ পাওয়ার কারো সুযোগ নেই। তবে গ্যাস সংকট সহসাই সমাধান করা যাবে না। বিদ্যুতের ট্যারিফ কাঠামো ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, যাতে পরবর্তী সরকার সুবিধাজনক অবস্থা পায়। তবে চুক্তি বাতিলের মতো বিষয়গুলোতে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই ‘প্রতিবন্ধকতা’ দূর করে ক্যাপাসিটি চার্জের ফাঁস এবং জ্বালানি খাতের সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে চাপবে এক বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।