বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন যখন শোষণের আর্তনাদ

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ২০ অগাস্ট ২০২৫ | ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন


নগরীর বুকে যখন মধ্যরাত নামে, কিংবা ভোরের আলো ফোটার আগে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে নেমে আসে এক অন্যরকম আঁধার। এ আঁধার আলোর অভাবের নয়, এ আঁধার মনুষ্যত্ব লোপ পাওয়ার, অসহায়ত্বকে পুঁজি করে লাভবান হওয়ার এক নির্লজ্জ উৎসবের। এখানে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন জীবন বাঁচানোর প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি শোনায় শোষণের এক নির্মম আর্তনাদ। এই আর্তনাদ সেই সন্তানের, যিনি মায়ের নিথর দেহখানা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, আর অবশেষে সিন্ডিকেটের বেঁধে দেওয়া অন্যায্য ভাড়ার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন।

একবার চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা কল্পনা করুন। আপনার সবচাইতে প্রিয় মানুষটি হাসপাতালের বিছানায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। শোকের পাথর বুকে চেপে যখন আপনি তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তখনই একদল হায়েনার মুখোমুখি হতে হয় আপনাকে। সাধারণ সময়ে যে পথের ভাড়া তিন থেকে চার হাজার টাকা, সেই পথের জন্যই আপনার কাছে দাবি করা হচ্ছে এগারো হাজার টাকা। আপনার হাতে কোনো বিকল্প নেই। কারণ হাসপাতালের ফটকগুলো এক অদৃশ্য দুর্গের মতো দখল করে রেখেছে একদল অসাধু চক্র। তাদের বাইরে থেকে কোনো অ্যাম্বুলেন্স ভেতরে ঢুকতে পারবে না, রোগী বা মরদেহ নিয়ে বের হতেও পারবে না। যদি কোনো হৃদয়বান চালক আপনার অসহায়ত্ব দেখে এগিয়ে আসতে চায়, তাকেও সম্মুখীন হতে হয় হুমকি আর শারীরিক লাঞ্ছনার।

এটা কোনো সিনেমার গল্প নয়, এটা বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের প্রধান হাসপাতালের নিত্যদিনের বাস্তবতা। এটা সেই ভুক্তভোগী সন্তানের বাস্তব অভিজ্ঞতা, যিনি চোখের জলে মায়ের মরদেহ নিয়ে গেছেন তিনগুণ বেশি ভাড়ায়। এটা সেই পরিবারের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যাদেরকে প্রিয়জনের লাশ হাসপাতাল থেকে বের করতে দেড় হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে বাইরের অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে হয়েছে। আর এই পুরো শোষণের যজ্ঞকে সুবিধা করে দিতে অকেজো করে ফেলে রাখা হয়েছে হাসপাতালের পাঁচটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স। বছরের পর বছর ধরে চলা এই ‘অ্যাম্বুলেন্স মাফিয়া’ চক্র প্রমাণ করে দিয়েছে, মানুষের অসহায়ত্বের চেয়ে বড় কোনো পণ্য আর নেই।

যখন দেখি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো এই সংকট উত্তরণে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি আরও ভারী হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কার দিকে তাকান। চরম অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেও তারা ‘সুওয়া সেরিয়া ১৯৯০’ নামের একটি জীবনদায়ী পরিষেবা চালু রেখেছে। একটি মাত্র টোল-ফ্রি নম্বরে ফোন করলেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করে সবচেয়ে দ্রুত পৌঁছাতে সক্ষম অ্যাম্বুলেন্সটি রোগীর দোরগোড়ায় হাজির হয়ে যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই অত্যাধুনিক সেবাটি দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে! যখন রাষ্ট্র তার নাগরিকের পাশে এমনভাবে দাঁড়ায়, তখন সিন্ডিকেটের মতো পরজীবী বেঁচে থাকার কোনো সুযোগই পায় না।

পাকিস্তানের মতো একটি দেশ, যা প্রায়শই নানা নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়, তারাও এই ক্ষেত্রে স্থাপন করেছে দুটি অসাধারণ উদাহরণ। একটি হলো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত ‘রেসকিউ ১১২১’ পরিষেবা, যা গড়ে মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। এটি কেবল একটি পরিবহন ব্যবস্থা নয়; এর প্রতিটি অ্যাম্বুলেন্সে থাকে প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক, যারা ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এর প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগিয়ে রোগীর জীবন বাঁচানোর লড়াই শুরু করে দেন। অন্যটি হলো মহৎপ্রাণ আবদুল সাত্তার ইধির ‘ইধি ফাউন্ডেশন’। কোনো প্রকার সরকারি সাহায্য ছাড়াই, কেবল সাধারণ মানুষের আস্থা ও অনুদানকে পুঁজি করে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছে বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী অ্যাম্বুলেন্স নেটওয়ার্ক। এই দুটি মডেলের সমন্বিত প্রয়াসে পাকিস্তানে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আজ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

এমনকি লাওসের মতো ছোট দেশেও ‘ভিয়েনতিয়েন রেসকিউ’-এর মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রমাণ করেছে যে, সদিচ্ছা থাকলে সীমিত সম্পদ নিয়েও মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। এই আন্তর্জাতিক উদাহরণগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব নয়। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, সমন্বিত পরিকল্পনা এবং সাহসী পদক্ষেপ।

তাহলে চট্টগ্রামের জন্য, তথা সমগ্র বাংলাদেশের জন্য আমাদের করণীয় কী?

প্রথমত, আমাদের প্রয়োজন একটি একক, টোল-ফ্রি জাতীয় হটলাইন। এই একটি নম্বরই হবে কেন্দ্র এবং এর অধীনে নিবন্ধিত থাকবে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। যখন একজন অসহায় মানুষ হাসপাতালের গেটের সিন্ডিকেট সদস্যের কাছে না গিয়ে সরাসরি এই হটলাইনে ফোন করবে, তখনই এই শোষণমূলক ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করা সম্ভব হবে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের ভাবতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। চট্টগ্রাম বা ঢাকার মতো যানজটের নগরীতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রোগীর জন্য ‘মোটরসাইকেল অ্যাম্বুলেন্স’ হতে পারে যুগান্তকারী এক সমাধান। হাওর, চর বা বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য প্রয়োজন ‘বোট অ্যাম্বুলেন্স’। আমাদের অ্যাম্বুলেন্স বহরে এই বৈচিত্র্য আনা অপরিহার্য।

তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অ্যাম্বুলেন্স চালককে কেবল একজন চালক হিসেবে দেখলে চলবে না। তাকে ‘জরুরি চিকিৎসা কর্মী’ বা প্যারামেডিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জাতীয়ভাবে প্রশিক্ষণ ও সনদায়ন কর্মসূচি চালু করতে হবে, যা নিশ্চিত করবে যে একজন রোগী হাসপাতালে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত জীবনরক্ষাকারী প্রাথমিক চিকিৎসা পাচ্ছেন।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্থায়ন আসবে কোথা থেকে? মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা মাতৃত্বকালীন জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতিতে এই সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা নাগরিকের অধিকার। অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকার একটি যৌক্তিক ভাড়ার তালিকা নির্ধারণ করে দিতে পারে। পাশাপাশি, পাকিস্তানের ইধি মডেলকে অনুসরণ করে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর), যাকাত এবং সাধারণ মানুষের অনুদান দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে।

সবশেষে বলতে চাই, অ্যাম্বুলেন্স কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়, এটি একটি জনকল্যাণমূলক অধিকার। সিন্ডিকেটগুলো আমাদের সমাজের সেই দুষ্টক্ষত, যা মানুষের সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্তে আক্রমণ করে। এই দানবদের রুখতে শুধু আইন প্রয়োগ বা অভিযানই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন জনগণের আস্থা অর্জন করা। দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ দালালের খপ্পরে না পড়ে সরাসরি হটলাইনে যোগাযোগ করে। রেড ক্রিসেন্টের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক ‘স্বেচ্ছাসেবী অ্যাম্বুলেন্স ব্রিগেড’ গড়ে তোলা যেতে পারে, যা মানুষের মধ্যে সেবার মানসিকতা তৈরি করবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় স্বজনদের কান্না আর দীর্ঘশ্বাস আমাদের বিবেককে আর কতদিন নাড়া দেবে? অ্যাম্বুলেন্স সমিতির নেতাদের অস্বীকার আর কর্তৃপক্ষের গতানুগতিক আশ্বাসের ফাঁদে আটকে থাকবে আর কত জীবন? এই সিন্ডিকেট ভাঙার কাজটি কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। কারণ জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিটি সেকেন্ডই অমূল্য। পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়, আর এক মুহূর্ত দেরি করার সুযোগ আমাদের নেই। কারণ এই নীরবতা আর উদাসীনতার ভার বহন করতে করতে আমরা এক মানবিকতাহীন সমাজে পরিণত হচ্ছি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।