বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

ব্যাংক খাতে মহালুট: এলসির আড়ালে পাচার ২২ লাখ কোটি টাকা, শীর্ষে এস আলম

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ৩০ অগাস্ট ২০২৫ | ১২:৪৭ অপরাহ্ন


ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাত থেকে কী পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে, তার এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে। পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে লেটার অফ ক্রেডিট বা এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হয়েছে অন্তত ২২ লাখ কোটি টাকা। এই মহালুটের শীর্ষে রয়েছে এস আলম গ্রুপ, যার একাই পাচার করেছে সোয়া এক লাখ কোটি টাকা। তাদের পরেই রয়েছে বেক্সিমকো, নাসা, ক্রিসেন্ট ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত দেড় দশকে দেশ থেকে মোট ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। এর প্রায় ৭৫ শতাংশই হয়েছে বাণিজ্য জালিয়াতির মাধ্যমে, যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৫৫০ কোটি ডলারে বা প্রায় ২২ লাখ কোটি টাকায়। কাগুজে কোম্পানি খুলে, পণ্যের মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এবং কখনো কখনো কোনো পণ্য আমদানি না করেই এলসির পুরো টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যেভাবে চলতো লুটপাটের মহোৎসব

এই অর্থ পাচারের পেছনে ছিল রাজনৈতিক প্রভাবশালী, ব্যাংকের संचालक এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা ভুয়া জামানত, অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে ঋণ এবং প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেখানোর মতো নানা কৌশল ব্যবহার করেছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাপে এবং পদোন্নতির লোভে ব্যাংক কর্মকর্তারা এই জালিয়াতিতে সহায়তা করেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সবকিছু জেনেও নীরব ভূমিকা পালন করায় ব্যাংক ডাকাতির এই ঘটনাগুলো ঘটেছে নির্বিঘ্নে।

বিশেষ করে, ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো ছিল অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ একাই নয়টি ব্যাংক নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন এবং সেই ব্যাংকগুলো থেকেই ভুয়া এলসি খুলে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে সরিয়ে নেন।

পাচারের শীর্ষে যারা

* এস আলম গ্রুপ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এখন পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির তথ্য মিলেছে, যার মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকাই বিদেশে পাচার করা হয়েছে। শুধু ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখা থেকেই অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে ১৮ হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়, যা এখন পুরোটাই খেলাপি ঋণ।

* বেক্সিমকো গ্রুপ: সালমান এফ রহমানের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। এই ঋণের বড় একটি অংশ ক্রেডিট কার্ড ও এলসির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়।

* ‘সৎ’ মন্ত্রীর ভয়ংকর রূপ: ভূমিমন্ত্রী থাকাকালে সাইফুজ্জামান চৌধুরী নিজেকে অত্যন্ত সৎ হিসেবে প্রচার করতেন। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর তার মুখোশ উন্মোচিত হয়। তিনি শুধু ইউসিবি ব্যাংক থেকেই এলসি ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পাচার করে বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।

* অন্যান্য বড় খেলোয়াড়: এই তালিকায় আরও আছে অ্যানন টেক্স গ্রুপ (৯ হাজার কোটি টাকা), ক্রিসেন্ট গ্রুপ (৫ হাজার কোটি টাকা), বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু (৫ হাজার কোটি টাকা), হলমার্ক গ্রুপ (৪ হাজার কোটি টাকা) এবং বিসমিল্লাহ গ্রুপ (১ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। এদের প্রায় সবাই ভুয়া রপ্তানি বা আমদানির নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে।

ফেরত আসবে কি এই টাকা?

অর্থনীতিবিদরা এই বিপুল পরিমাণ পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গভীর সংশয় প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “পাচারকারীদের চিহ্নিত করা গেলেও টাকা ফিরিয়ে আনার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। আদালতের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এই টাকা ফিরিয়ে আনা যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।”

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়, যার সিংহভাগই ঘটে বস্ত্র, ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানির আড়ালে। এই সিস্টেমিক লুটপাট দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে, যার দায়ভার এখন বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।