বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

বদলে যাচ্ছে বিশ্বব্যবস্থা, চালকের আসনে চীন?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৯:২৭ পূর্বাহ্ন

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন চত্বরের আকাশ সেদিন ছেয়ে গিয়েছিল ৮০ হাজার সাদা কবুতর আর রঙিন বেলুনে। নিচে লৌহকঠিন শৃঙ্খলায় পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল হাজারো সৈন্য, তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছিল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, আন্তঃমহাদেশীয় পারমাণবিক বোমা আর চালকবিহীন যুদ্ধবিমানের মতো সর্বাধুনিক সব মারণাস্ত্র। এই অভূতপূর্ব সামরিক প্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন থেকে শুরু করে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন পর্যন্ত অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। স্মিত হেসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ঘোষণা করলেন, ‘চীনা জাতি এক গর্বিত জাতি। কোনো স্বৈরশাসককেই সে ভয় করে না।’ এই বার্তার লক্ষ্য যে হাজার মাইল দূরের ওয়াশিংটন, তা বুঝতে কারও বাকি ছিল না।

এই বিশাল আয়োজনের আনুষ্ঠানিক কারণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন, কিন্তু এর আড়ালে ছিল ইতিহাসের এক নতুন বয়ান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এতদিন ধরে আমরা জেনে এসেছি যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধে জয়লাভের পেছনে প্রধান শক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সি সেই ইতিহাস নতুন করে লিখতে চাইলেন। তিনি দাবি করলেন, জাপান ও জার্মানিকে পরাস্ত করার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল চীন এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের প্রধান বিজয়ী শক্তি হিসেবে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত।’

এই ঐতিহাসিক ভিন্নমত প্রকাশের সাথে সাথেই ওয়াশিংটন থেকে তার জবাব আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ‘ভুলে যাবেন না, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মার্কিন সৈনিকদের রক্তত্যাগের ভেতর দিয়েই চীন তার মুক্তি অর্জন করেছিল।’ এই কথার লড়াই স্পষ্ট করে দেয় যে, বেইজিং ও ওয়াশিংটনের দ্বন্দ্ব এখন কেবল বাণিজ্য বা ভূ-রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই, তা ইতিহাসের ব্যাখ্যা পর্যন্ত গড়িয়েছে। তবে সির লক্ষ্য শুধু ইতিহাস পুনর্লিখন নয়, তিনি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকেই আমূল বদলে দিতে চান।

এই বৃহত্তর লক্ষ্যেরই প্রতিফলন দেখা যায় সামরিক কুচকাওয়াজের ঠিক আগে তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) এর শীর্ষ বৈঠকে। সেখানে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এর পাশে ছিলেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই তিন নেতার হাতে হাত মেলানোর দৃশ্যটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তারা যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইলেন, বিশ্ব এখন আমেরিকার নেতৃত্বে এক মেরুর নয়, বরং বহু মেরুর হয়ে উঠছে। একসময় যে ভারত ও চীনের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক ছিল, তারা আজ মার্কিন বাণিজ্য শুল্কের হুমকির মুখে একে অপরের কাছাকাছি এসেছে। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন প্রশ্নে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। এই পরিস্থিতিতে তিন বৃহৎ শক্তি মিলে এমন একটি জোটের আবহ তৈরি করেছে, যার মূল লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে আমেরিকার একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা। সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট সি রাখঢাক না রেখেই বলেন, ‘আমরা এমন এক বিশ্বব্যবব্যবস্থা চাই, যেখানে এক পরাশক্তির আধিপত্যের পরিবর্তে নিয়মনির্ভর বহু মেরুর এক ভিন্ন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে।’

নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একক অধিপতি হয়ে বসেছিল। কিন্তু গত দুই দশকে বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িয়ে এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আমেরিকার সেই একক প্রভাব কিছুটা কমেছে। ঠিক এই সময়েই চীন অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছে এবং মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প তৈরির পথে হেঁটেছে। এই পথচলারই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হলো ২০০১ সালে গঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) এবং ২০০৯ সালে গঠিত ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)।

মজার বিষয় হলো, এই বিকল্প জোটের ভাবনাটি আকস্মিক নয়। এর বীজ রোপিত হয়েছিল আরও আগে। নব্বইয়ের দশকে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েভগেনি প্রিমাকভ চীন, রাশিয়া ও ভারতকে নিয়ে একটি ‘ত্রইকা’ বা কৌশলগত ত্রিভুজ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন আধিপত্যের বিপরীতে একটি ভারসাম্য তৈরি করা। সেই সময়ের প্রচেষ্টা সফল না হলেও, আজকের এসসিও এবং ব্রিকস সেই ভাবনারই বাস্তব রূপ।

এই ভাবনার সূত্র ধরেই চীন তিয়ানজিন সম্মেলনে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা হাজির করে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্লোবাল গভর্ন্যান্স ইনিশিয়েটিভ’ বা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা উদ্যোগ। এর অধীনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বিকল্প হিসেবে একটি নতুন উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন সি চিন পিং এবং প্রাথমিকভাবে এর জন্য দুই বিলিয়ন ইউয়ান দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

এই নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হলো মার্কিন ডলারের আধিপত্য খর্ব করা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মূলত ডলারে হয়, যা আমেরিকাকে বিশ্বের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেয়। ইরান বা রাশিয়ার মতো দেশের ওপর আমেরিকা যখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন ডলার-ভিত্তিক ব্যবস্থা তাদের কাবু করে ফেলে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতেই ব্রিকস এবং এসসিও জোটভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য করার পাশাপাশি একটি বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর কথা ভাবছে। এই উদ্যোগকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন। সোজা কথায়, তারা বলছেন—ডলারের একাধিপত্য আর নয়।

বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণের এই লড়াই নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও উদ্বিগ্ন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো ডলারের বিকল্প চালু করলে তাদের ওপর ১০০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করা হবে। কিন্তু তিয়ানজিনের সম্মেলন প্রমাণ করে, সেই হুমকিতে কেউ ভয় পাচ্ছে না।

পরিশেষে বলা যায়, চীনের নেতৃত্বে একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা রাতারাতি গড়ে উঠবে না, তবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে গেছে। পরিহাসের বিষয় হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি এবং একতরফা বাণিজ্যযুদ্ধই তার প্রতিপক্ষদের একজোট হতে সাহায্য করছে। বিশ্বজুড়ে আমেরিকার প্রভাব যখন কমছে, তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসছে চীন। বেইজিং এবং তিয়ানজিন থেকে আসা বার্তাটি অত্যন্ত স্পষ্ট: বিশ্ব ক্ষমতার ভারসাম্যে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।