বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট: ফরেনসিক অডিটের উদ্যোগ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার

‘অর্থ লোপাটের’ শ্বেতপত্রই সার, ১৩ মাসেও হয়নি দায়ীদের বিচার
একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১১:২৫ পূর্বাহ্ন


ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের আড়ালে বিপুল অর্থ লুণ্ঠনের অভিযোগ উঠলেও, গত ১৩ মাসে এর কোনোটিরই পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক অডিট করার উদ্যোগ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার।

উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কেলেঙ্কারি এবং কেনাকাটায় আর্থিক অনিয়মসহ বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বিশ্লেষকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।

‘ফরেনসিক অডিট’ হলো আর্থিক জালিয়াতি বা অপরাধ তদন্তের একটি বিশেষায়িত প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ ও অপরাধীদের শনাক্ত করা হয়। গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকেই এমন একটি নিরীক্ষার প্রত্যাশা করেছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত দেড় দশকে বাস্তবায়িত প্রায় ৪৮ লাখ কোটি টাকার বাজেটের একটি বড় অংশই গেছে উন্নয়ন প্রকল্পে, যার অর্থায়ন হয়েছে মূলত দেশি-বিদেশি ঋণের মাধ্যমে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন দেশের মোট ঋণ ছিল প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায়। মূলত এই ঋণের টাকায় বাস্তবায়ন করা পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, যেখানে প্রকল্পের খরচ ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’র প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি কেনাকাটা থেকে ঘুষ হিসেবেই ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে এবং দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকা। তবে এই পরিসংখ্যানকে ‘অনুমাননির্ভর’ উল্লেখ করে কমিটি বলেছে, প্রকৃত চিত্র উদঘাটনে পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক অডিট প্রয়োজন।

একইভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ, আইসিটি খাতের কেনাকাটা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটলেও এসব বিষয়ে কোনো বিশেষায়িত নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট শুরু হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আলোচনার বাইরেই থেকে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকারি ব্যয়ের বড় ধরনের একটি ফরেনসিক অডিট করতে হলে সরকারের সব দপ্তরের সমন্বিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন, যা বেশ কঠিন। তার চেয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য বা পরিবহন খাতের মতো বড় দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলোতে আগে ফরেনসিক অডিট করা যেতে পারে।”

এ বিষয়ে সরকারের ধীরগতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, “নতুন সরকার আসার পর প্রথম দায়িত্ব ছিল পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সংস্কার করা। কিন্তু সে রকম কিছুই হয়নি। সঠিক পথে অগ্রসর হলে এক বছরে আর্থিক খাত একটি দিকনির্দেশনার মধ্যে চলে আসত।”

তবে সরকারের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, “উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমলাতন্ত্র দিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হচ্ছে। আমরা চাইলেই রাতারাতি সব পরিবর্তন করতে পারব না। অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে সবকিছু শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারেরও এখানে বড় ভূমিকা রয়েছে।”