
এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। ক্ষমতার পালাবদলের সেই উত্তাল দিনগুলোতে চট্টগ্রামের ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে এসেছিল পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের বাতাবরণের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল এক অশনিসংকেত, যার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি আজ চট্টগ্রাম নগরীর জননিরাপত্তাকে এক ভয়াবহ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনও নগরীর জন্য এক বিষফোঁড়া হয়ে রয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ব্যাপক অভিযান চালিয়ে অধিকাংশ অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হলেও, এখনও ১৫৫টি ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের কোনো হদিস মেলেনি। সঙ্গে নিখোঁজ রয়েছে ১৯ হাজারেরও বেশি কার্তুজ। এই না পাওয়া অস্ত্রগুলোই এখন নগরীর অপরাধ জগতের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা ছিনতাই, ডাকাতি থেকে শুরু করে ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের সেই অশান্ত দিনে আটটি থানা ও আটটি ফাঁড়ি থেকে মোট ৯৪৮টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছিল। এর পাশাপাশি ৭৯ হাজার ৮২৪টি কার্তুজ ও গোলাবারুদ এবং প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টিয়ার শেল ও গ্যাস গ্রেনেডও দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যায়। নিঃসন্দেহে এটি ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য এক বিরাট বিপর্যয়।
বিগত এক বছরে সিএমপি সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ৭৯৩টি অস্ত্র এবং ৬০ হাজার ৬৬১টি কার্তুজ উদ্ধার করেছে, যা তাদের চেষ্টার একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু যে ১৫৫টি অস্ত্র এখনও অপরাধীদের হাতে রয়ে গেছে, সেগুলোর বিধ্বংসী ক্ষমতা নগরীর শান্তিশৃঙ্খলাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে চলেছে। নিখোঁজ অস্ত্রের তালিকায় রয়েছে ১৮টি ৭.৬২ মিমি চায়না রাইফেল, ৮টি এসএমজি, ১৬টি চায়না পিস্তল, ৪২টি ৯ মিমি পিস্তল এবং ৫৫টি ১২ বোর শটগান। এই ধরনের অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী অস্ত্র যখন কোনো সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের হাতে থাকে, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তা সহজেই অনুমেয়।
উদ্বেগের বিষয় হলো, এই লুট হওয়া অস্ত্রগুলো এখন আর নিছক কোনো পরিসংখ্যান নয়, বরং নগরীর রাস্তায় এগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া একাধিক অপরাধমূলক ঘটনা প্রমাণ করে, এই ‘ভৌতিক অস্ত্রগুলো’ অপরাধীদের হাতে কতটা সক্রিয়। চলতি বছরের ১৭ জুন নগরীর মেরিন সড়ক এলাকা থেকে রুবেল নামের এক ব্যক্তিকে যে পিস্তলসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তদন্তে বেরিয়ে আসে সেটি ছিল থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র।
এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গত বছরের ২৯ আগস্ট, যখন বায়েজিদ-হাটহাজারী থানা এলাকায় মাসুদ কায়সার ও আনিস নামের দুজনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া কার্তুজের খোসা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় যে, সেগুলোও লুট হওয়া অস্ত্রের। এই হত্যাকাণ্ডটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে জনগণের সম্পদ জনগণের বিরুদ্ধেই প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।
অপরাধের এই ধারা এখানেই থেমে থাকেনি। চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল ডবলমুরিং থানার বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে আরিফ নামে আরেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যে লুট হওয়া অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ সংগঠিত করত। সর্বশেষ গত ২১ জুলাই চান্দগাঁও এলাকায় ‘সন্ত্রাসী’ ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পো এবং শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যার বাহিনীর মধ্যে যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, সেখানেও ব্যবহৃত হয়েছিল সিএমপির খোয়া যাওয়া অস্ত্র।
এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধ নয়, বরং একটি বিপজ্জনক প্রবণতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো এখন নগরীর অপরাধ মানচিত্রকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ডাকাতি এবং গ্যাং ওয়ারের মতো ঘটনায় এগুলোর অবাধ ব্যবহার নগরবাসীর মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) মুখপাত্র এডিসি শ্রীমা চাকমা জানিয়েছেন, বাকি অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং প্রতিটি থানাকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশের এই প্রচেষ্টা প্রশংসার যোগ্য এবং তাদের নিরলস অভিযানের কারণেই রুবেল, আরিফ, টেম্পো ও বুইস্যার মতো অপরাধীরা আইনের আওতায় এসেছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, একটি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন দেড় শতাধিক মারণাস্ত্র এবং হাজার হাজার গুলি অপরাধ জগতের গভীরে ছড়িয়ে থাকে, তখন প্রচলিত অভিযানের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অস্ত্রগুলো সম্ভবত এরই মধ্যে একাধিকবার হাতবদল হয়েছে এবং নগরীর অন্ধকার গলি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাই গতানুগতিক অভিযানের পাশাপাশি প্রয়োজন এক সমন্বিত ও কৌশলগত পদক্ষেপ।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গোয়েন্দা কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত করা। অস্ত্রগুলো কাদের হাতে রয়েছে, কোথায় সেগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছে এবং কোন অপরাধী চক্র সেগুলো ব্যবহার করছে, তা খুঁজে বের করতে নিবিড় গোয়েন্দা নজরদারির কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে, সাধারণ মানুষকেও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে। একটি নিরাপদ ও গোপনীয় তথ্য প্রদান ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যেখানে সাধারণ নাগরিকেরা নির্ভয়ে অস্ত্র সংক্রান্ত তথ্য পুলিশকে জানাতে পারবেন। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া এই বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার খুঁজে বের করা অত্যন্ত কঠিন।
যতদিন পর্যন্ত লুট হওয়া শেষ অস্ত্রটি উদ্ধার না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর কোনো নাগরিকই পুরোপুরি নিরাপদ বোধ করতে পারে না। এই ১৫৫টি অস্ত্র ১৫৫টি চলমান টাইম বোমার মতো, যা যেকোনো মুহূর্তে নগরীর যেকোনো প্রান্তে বিস্ফোরিত হতে পারে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তাই তাদের সর্বশক্তি দিয়ে এই অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানকে সফল করতে হবে। এটি কেবল আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি চট্টগ্রাম নগরীর লাখ লাখ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।