বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

যেখানে পাথর আর জলে লেখা হয় প্রকৃতির মহাকাব্য

জাকির হোসেন | প্রকাশিতঃ ৫ নভেম্বর ২০২৫ | ৬:০৮ অপরাহ্ন


গভীর অরণ্যের বুক চিরে নেমে আসছে জলের স্রোত। পাখির ডাক, সবুজে ঘেরা পাহাড় আর বিশাল শীলা পাথর বেয়ে পড়া সেই জলের শীতল ছিটে—সব মিলিয়ে এক অপার্থিব আবেশ। এটি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে প্রকৃতির এক গোপন বিস্ময়, শীলাছড়া ঝর্ণা। রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার সীমানা ঘেঁষে, যেন দুই জেলার প্রাকৃতিক বন্ধনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই অনিন্দ্যসুন্দর জলধারা।

এই সৌন্দর্যের দেখা পাওয়া অবশ্য সহজ নয়। দীঘিনালা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার গাড়িপথে ডাঙ্গা বাজার, এরপর আরও প্রায় ৭ কিলোমিটার পূর্ব দিকে পায়ে হাঁটা পথ। কিন্তু, এই দুই ঘণ্টার হাঁটাপথই যেন এক ভ্রমণ। পাহাড়িদের সহজ-সরল জীবনযাত্রা, ছড়ার তীরে ছোট্ট শিশুদের নির্মল হাসি, পাখির কিচিরমিচির আর ঝিরিপথের মিষ্টি জলধারা দীর্ঘ পথের ক্লান্তি এক নিমিষেই ভুলিয়ে দেয়।

স্থানীয়দের মতে, ‘শীলা’ বা প্রচুর পাথর থেকেই ‘শীলাছড়া’ নামের উৎপত্তি। ঝর্ণার পথে এগোতেই বোঝা যায় নামের সার্থকতা। বিশাল বিশাল শীলা পাথর কেটে বয়ে চলেছে পানির ধারা, মনে হয় যেন কোনো স্বর্গীয় সংগীত।

এটি মূলত ৫-৬টি ছোট-বড় ঝর্ণার এক অপূর্ব সমন্বয়। প্রায় ২০-২৫ মিটার উপর থেকে প্রতিটি ঝর্ণা আলাদা উচ্চতা থেকে নেমে এসে মিলছে নিচের বৃত্তাকার ঝিরিতে। তবে এই সৌন্দর্য উপভোগের পথটি বেশ রোমাঞ্চকর। বিশাল পিছল পাথর বেয়ে ঝর্ণার মূল উৎসে উঠতে হয়, সামান্য অসাবধানতায় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।

কিন্তু সেই ভয় মুহূর্তেই উবে যায় যখন শীলা পাথরের পাহাড় থেকে অঝরে ঝরা জলের শীতল স্পর্শ গায়ে লাগে। আর সেই জলে যখন সোনালি রোদ পড়ে, তখন রংধনুর খেলায় একে কোনো বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা জীবনের শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম বলে বিভ্রম হয়।

জেলা শহর থেকে এই রোমাঞ্চের টানে ছুটে আসা দর্শনার্থী রুহুল আমিন তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। রুহুল আমিন বলেন, “শীলাছড়ার ঝর্ণাটি আমার দেখা সব থেকে সুন্দর ঝর্ণা। এতদূর থেকে এসে প্রায় ২ ঘণ্টার দীর্ঘ ঝিরি ও পাথর বেয়ে ঝর্ণাগুলোর দর্শন পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে। পাথর আর পাহাড় পেড়িয়ে এটি ছিল রোমাঞ্চকর এক অ্যাডভেঞ্চার, যা স্মৃতির পাতায় সারা জীবন থেকে যাবে।”

আরেক দর্শনার্থী স্বপন বিকাশ চাকমা প্রকৃতির এই সৃষ্টির সাথে একাত্মতা বোধ করেন। স্বপন বিকাশ চাকমা জানান, “শীলাছড়া ঝর্ণাটি প্রকৃতির অপরুপ সৃষ্টি। ঝর্ণাটি আমাদের স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যারা প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করতে চান, তাদের জন্য শীলাছড়া ঝর্ণা সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা।”

প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এই প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে আশাবাদী। দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুহাম্মাদ ইনামুল হাছান বলেন, “দীঘিনালায় যতগুলো ঝর্ণা রয়েছে তার মধ্যে মনে হচ্ছে প্রকৃতির সৃষ্টির অন্যতম সুন্দর আর রোমাঞ্চকর ঝর্ণা শীলাছড়া ঝর্ণা। দীর্ঘ এডভেঞ্চার, ঝর্ণার জলে গা ভেজানো আর অপরুপ শীলা পাথরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এ ঝর্নাটি হতে পারে দর্শনার্থীদের অন্যতম ভ্রমণের জায়গা।”

শীলাছড়া কেবল একটি ঝর্ণা নয়, এটি একটি আস্ত অ্যাডভেঞ্চার আর প্রশান্তির এক নিখুঁত মিশ্রণ, যা শহুরে ক্লান্তি ধুয়ে দিতে পারে এক নিমিষেই।