
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তার সর্বশেষ ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তা এক ঝলক স্বস্তির বাতাস নিয়ে এসেছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।
কিন্তু এই আশাবাদের পিঠে সওয়ার হয়ে আছে চারটি বড় চ্যালেঞ্জ—রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ঘন ঘন বন্যা, শ্রমিক অস্থিরতা ও আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতি। যখন জাতীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের আলোচনা হয়, তখন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের ভাগ্যকে পৃথক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বরং জাতীয় চ্যালেঞ্জগুলো চট্টগ্রামের মাটিতে আরও গভীর ও জটিল রূপে আবির্ভূত হয়, যা এই শহরের সম্ভাবনাকে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করে চলেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রবেশদ্বার। দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি এই বন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এডিবির প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ঝুঁকি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের শঙ্কা এবং ইউরোপীয় বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির যে কথা বলা হয়েছে, তার প্রথম ও প্রধান ধাক্কাটি লাগবে চট্টগ্রামের ওপর।
এখানকার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) এবং অসংখ্য তৈরি পোশাক কারখানা দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগের জোগান দেয়। শুল্কের খাঁড়া নেমে এলে বা প্রতিযোগিতা তীব্র হলে রপ্তানিকারকদের পণ্যের দাম কমাতে হবে, যা শিল্প প্রবৃদ্ধিকে শুধু সীমিত করবে না, বরং চট্টগ্রামের হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন-জীবিকার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জন্য যে তিনটি শর্তের কথা বলেছেন—ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ—তার প্রতিটিই চট্টগ্রামের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার চট্টগ্রামে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য মিরসরাইয়ে অবস্থিত জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বে-টার্মিনাল এবং কর্ণফুলী টানেলের মতো যুগান্তকারী প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পগুলো ঘিরে যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়ার কথা, তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে ‘বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা’ নামক কঠিন বাস্তবতার সামনে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুকতা বিনিয়োগকারীদের মনে দ্বিধা তৈরি করে। চট্টগ্রামে নতুন শিল্প স্থাপন বা বিদ্যমান শিল্পের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এই দ্বিধা আরও প্রকট। ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং ঋণপ্রাপ্তির জটিলতা এখানকার উদ্যোক্তাদের জন্য আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা। ফলে বিশাল অবকাঠামোগত উন্নয়ন সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বেসরকারি বিনিয়োগ আসছে না, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
প্রতিবেদনে উল্লিখিত চারটি জাতীয় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ‘ঘন ঘন বন্যা’ চট্টগ্রামের জন্য একটি মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রতি বর্ষায় পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা কেবল নগর জীবনকে বিপর্যস্ত করে না, বরং হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি করে। জলাবদ্ধতার কারণে খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইয়ের মতো দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার স্থবির হয়ে পড়ে, সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় মূল্যস্ফীতিতে। যখন একটি শহরের মূল বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো বছরে বেশ কয়েকবার পানির নিচে তলিয়ে যায়, তখন তা ব্যবসায়িক পরিবেশের ওপর কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা সহজেই অনুমেয়। এই একটি মাত্র কারণেই চট্টগ্রামে বিনিয়োগের আস্থা তলানিতে পৌঁছাতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিহার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ সরবরাহ ব্যবস্থায় গলদ রয়ে গেছে। এই গলদের একটি প্রকট উদাহরণ চট্টগ্রাম। বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার যে সাপ্লাই চেইন, তার প্রতিটি ধাপে চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ যেমনটি স্বীকার করেছেন, ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও বাজারের অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্বত্বভোগীরা এখনো সক্রিয়। চট্টগ্রাম এই মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বর্গরাজ্য। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও কিংবা সরকার শুল্ক হ্রাস করলেও তার সুফল ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছায় না। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির দৈত্যকে বোতলে ভরা যাবে না।
রপ্তানি বহুমুখীকরণের যে প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম সেখানেও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু গার্মেন্টসনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে জাহাজ নির্মাণ, ইস্পাত, পর্যটন ও সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ খাতে চট্টগ্রাম বিপুল সম্ভাবনা ধারণ করে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, শ্রমিক অসন্তোষ এবং সর্বোপরি অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা (বিশেষ করে জলাবদ্ধতা) এই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে।
পরিশেষে, এডিবির প্রতিবেদন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি মিশ্র বার্তা দিয়েছে। একদিকে যেমন ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, তেমনই কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো সেই সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই সমীকরণে চট্টগ্রাম একটি নির্ণায়কের ভূমিকায় রয়েছে।
যদি চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায়, এখানকার ব্যবসায়িক পরিবেশকে চাঁদাবাজমুক্ত করে বিনিয়োগের আস্থা ফেরানো যায় এবং রপ্তানি বহুমুখীকরণে এখানকার শিল্পগুলোকে প্রণোদনা দেওয়া যায়, তবেই জাতীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের পথ সুগম হবে। অন্যথায়, ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন বাণিজ্যিক রাজধানীর জলাবদ্ধ পানিতেই ভেসে যাবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হবে চট্টগ্রামের বন্দর, শিল্পাঞ্চল এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর কার্যকর ব্যবস্থাপনার ওপর।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।