
শিক্ষকতা জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শেষ বেলায় এসে যখন প্রাক-প্রাথমিকের প্রশিক্ষণে অংশ নিলাম, তখন ভাবিনি আমার জন্য এক নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে যাবে। ছোট ছোট সোনামণিদের নিয়ে ক্লাস করার যে অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হলো, তা আমার বাকি কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
এই শিশুদের নিষ্পাপ জগৎটাই যেন ভিন্ন। তাদের সাথে কথা বলা, গল্প শোনা, ইচ্ছেমতো খেলতে দেওয়া, বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে তাদের চোখে দেখা জগৎটাকে তাদের মুখেই শোনার আনন্দই আলাদা। ছড়া আবৃত্তি, আঁকিবুঁকি আর নানা ধরনের খেলায় তাদের সাথে মিশে গিয়ে আমি নিজেই যেন শৈশবে ফিরে যাই।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি বাস্তব ঘটনা বলি। একদিন এক অভিভাবক বিদ্যালয়ে এসে আমাকে বললেন, “স্যার, আমার বাচ্চাটাকে ইচ্ছে মতো পিটাবেন!”
কথাটা শুনে আমি রীতিমতো অবাক! সবেমাত্র পাঁচ পেরিয়েছে যে শিশু, তাকে কেন পেটাব? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি বললেন, “স্যার, ও আমার কথা একদম শোনে না!”
আমি বললাম, “তাহলে তো সমস্যা। ওকে একজন কানের ডাক্তার দেখান।”
তিনি অবাক হয়ে বললেন, “কানের ডাক্তার কেন স্যার?”
আমি উত্তরে বললাম, “আপনার কথা যেহেতু কানে শোনে না, তাই বললাম আরকি।”
তিনি বিব্রত হয়ে বললেন, “না স্যার, কানে ও ঠিকই শোনে, কিন্তু আমার কথা মানে না। পড়তে বসতে বললে বসে না।”
আমি তাকে বোঝালাম, “আমি তো বাড়িতে ওদের পড়তে নিষেধ করেছি। ওদের বই, খাতা, খেলনা সবই তো বিদ্যালয়ে সংরক্ষিত থাকে। যা শেখার, ওরা তো এখানেই শিখবে। সরকার তো ওকে বাড়িতে পড়ার জন্য বই দেয়নি।”
অভিভাবক আবার অভিযোগের সুরে বললেন, “স্যার, ওকে ব্যাগ নিয়ে আসতে বললে আনে না।”
আমি হাসলাম। বললাম, “প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের তো আমিই ব্যাগ আনতে বারণ করেছি। ওরা এখানে আসবে, হাসবে, খেলবে, বর্ণ চিনবে, ইচ্ছেমতো দৌড়াবে—এটাই তো ওদের প্রধান কাজ।”
শেষে তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “স্যার, ও বড্ড দুষ্টুমি করে।”
এবার আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বললাম, “এই বয়সে আপনি কি স্কুলের বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকতেন?”
তিনি মুচকি হেসে বললেন, “না স্যার।”
আমি তখন বললাম, “এই বয়সে আমিও দুষ্টু ছিলাম, আমার দাদাও দুষ্টু ছিলেন। বয়সটাই এমন। ওরা সবসময় কল্পনার জগতে থাকে। হাসতে, দৌড়াতে, খেলতে, আঁকিবুঁকি করতে ভালোবাসে।”
আসলে আমরা অনেক অভিভাবকই শিশুদের মন বুঝতে চাই না। তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করি না। তাদের সাথে হাসতে হবে, খেলতে হবে, ঠাট্টা করতে হবে। তবেই তো তাদের ভেতর আত্মবিশ্বাস জন্মাবে। কিন্তু তা না করে আমরা তুলনা করি, “অমুকের ছেলেটা সব পারে, তুই পারিস না কেন?” আর এভাবেই শুরু হয় এক অসম প্রতিযোগিতা, যার কষ্টের কথা আমি শিশুদের মুখ থেকেই শুনি।
মনে রাখবেন, আপনার সন্তানের সাথে যদি হাসিমুখে কথা বলেন, ওদের আত্মবিশ্বাস পাহাড়ের মতো উঁচু হবে। আর যদি ধমক দেন, তবে তার ফলাফল বিপরীতও হতে পারে। আপনার সন্তান লেখাপড়ায় একটু দুর্বল, তাতে কী হয়েছে? হতে পারে সে খেলাধুলায় অনেক দক্ষ। কে বলতে পারে, সে-ই হয়তো একদিনের মেসি, নেইমার, রোনালদো বা আকরাম খানের মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হবে!
এই শিশুদের মধ্য থেকেই তো উঠে আসবে বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার, প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী। ওরাই তো আগামী দিনের কাণ্ডারী—হতে পারে পাইলট, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, সেনাপ্রধান, পুলিশপ্রধান, ব্যাংক গভর্নর, সফল ব্যবসায়ী, কম্পিউটার বিজ্ঞানী অথবা মহাকাশচারী।
পাঁচ থেকে আঠারো বছর পর্যন্ত ওদের শিশু বলা হলেও তেরো থেকে উনিশ বছর বয়সটা খুব সংবেদনশীল। এই সময়ে তাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি না করে বন্ধু হতে হবে। তারা কোথায় যায়, কাদের সাথে মেশে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো ভুল করলে ধমক দিয়ে নয়, ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হবে। কারণ চাপ দিলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
কবির ভাষায় বলতে হয়, “ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।”
আগামীর এই পৃথিবী নামক গ্রহটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো এই শিশুদেরই হাতে। তাই তাদের সেভাবেই ভালোবাসা দিয়ে, আত্মবিশ্বাস দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এই অবুঝ শিশুদের হাত ধরেই শান্তিময় হোক আমাদের এই নীল গ্রহ। পৃথিবীর সকল শিশুর জন্য রইল আমার অন্তহীন শুভকামনা।
উৎসর্গ: আমার প্রথম কন্যা প্রয়াত জান্নাতুল মাওয়া।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।