বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

জঙ্গল সলিমপুর: এ রক্তক্ষরণ গণমাধ্যমের নয়, রাষ্ট্রের হৃদপিণ্ডে

শরীফুল রুকন | প্রকাশিতঃ ৬ অক্টোবর ২০২৫ | ৮:২৩ অপরাহ্ন


যখন আমাদের কোনো সহকর্মীর মাথা থেকে রক্ত ঝরে, তখন তা শুধু একটি সংবাদ হয়ে থাকে না; তা আমাদের প্রতিটি রিপোর্টারের হৃদপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করে। একটি ভাঙা ক্যামেরা শুধু যন্ত্রের ক্ষতি নয়, সেটি সত্য তুলে ধরার চেষ্টার ওপর এক পাশবিক আস্ফালন। এখন টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, আমাদের ভাই হোসাইন জিয়াদ এবং ক্যামেরাপার্সন মো. পারভেজের ওপর যে নারকীয় হামলা হয়েছে, তা আমাদের আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—সত্য বলার ‘অপরাধে’ এই দেশে কতটা অসহায় আমরা সাংবাদিকেরা।

এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সুপরিকল্পিত বার্তা, যা চট্টগ্রামের সকল সাংবাদিককে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে: ভয় পাও, চুপ থাকো। জঙ্গল সলিমপুর নামক যে আইনবিহীন ভূখণ্ডটি চট্টগ্রামের বুকে ক্যানসারের মতো বেড়ে উঠেছে, তা আজ আমাদের কলম আর ক্যামেরার সামনে এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই হামলা আমাদের পেশার ওপর, সত্য তুলে ধরার প্রত্যয়ের ওপর এক কাপুরুষোচিত আঘাত। এই হামলা প্রমাণ করে, সেখানে রাষ্ট্রীয় আইনের কোনো অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা হলো সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব আর মাফিয়াদের নিজস্ব শাসন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেখানে সাংবাদিকদের এমন পাশবিকতার শিকার হওয়া কেবল গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত নয়, এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতিও এক নির্লজ্জ চ্যালেঞ্জ।

একজন রিপোর্টার হিসেবে, বছরের পর বছর ধরে আমরা জঙ্গল সলিমপুরের উত্থান দেখেছি। আমরা জানি এটি কী। এটি শুধু কোনো অবৈধ জনপদ নয়; এটি চট্টগ্রামের বুকে প্রায় তিন হাজার একরের এক গভীর ক্ষত, যেখানে রাষ্ট্র নয়, সন্ত্রাসীরাই আইন। ভূমিদস্যু, অস্ত্রধারী খুনি, মাদক কারবারি আর পলাতক আসামিদের এই অভয়ারণ্যে প্রবেশ করা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জেনেও আমাদের সহকর্মীরা সেখানে গিয়েছিলেন। কারণ এটাই আমাদের কাজ—ভয়কে জয় করে মানুষের জন্য খবর তুলে আনা। দুই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংঘর্ষে প্রাণহানির পর সেই খবর সংগ্রহ করতে যাওয়াই ছিল তাদের ‘অপরাধ’। সন্ত্রাসীরা দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে, ক্যামেরা ভেঙে চুরমার করেছে। এর মাধ্যমে তারা একটি বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে—এই অন্ধকার জগতে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নেই।

আমরা বুঝি, সন্ত্রাসীদের এই উন্মত্ততার কারণ কী। সরকার যখন এই অপরাধের স্বর্গরাজ্যকে উচ্ছেদ করে একটি জনহিতকর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। এই মহাপরিকল্পনার খবর যত বেশি গণমাধ্যমে আসবে, ততই তাদের হাজার কোটি টাকার অবৈধ দখলদারি ও অপরাধের সাম্রাজ্য জনরোষ ও প্রশাসনিক চাপের মুখে পড়বে। আমাদের সহকর্মীরা ঠিক সেই কাজটিই করে আসছেন। তারা দেখিয়ে আসছেন, কীভাবে একটি অপরাধের জনপদকে বদলে দিয়ে সেখানে সাধারণ মানুষের জন্য আবাসন, ক্রীড়া কেন্দ্র বা দৃষ্টিনন্দন সাফারি পার্ক তৈরি করা সম্ভব। আর একারণেই সত্যের আলোয় নিজেদের মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে তারা সাংবাদিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। গণমাধ্যম তাদের কাছে সবচেয়ে বড় শত্রু, কারণ একটি ছবি বা একটি প্রতিবেদন তাদের বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা অপরাধের দুর্গটিকে কাচের ঘরের মতো ভেঙে দিতে পারে।

দুঃখের বিষয় হলো, জঙ্গল সলিমপুরে সাংবাদিকদের ওপর এটাই প্রথম হামলা নয়। এর আগেও বহুবার আমাদের সহকর্মীরা সেখানে লাঞ্ছিত হয়েছেন, হুমকি পেয়েছেন, তাদের সরঞ্জাম কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে এমন ঘটনার এক হতাশাজনক আর্কাইভ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পর আমরা রাস্তায় নেমেছি, প্রতিবাদ করেছি, ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিবারই মিলেছে তদন্তের ফাঁপা আশ্বাস আর ‘দুষ্কৃতকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না’ জাতীয় মুখস্থ বুলি। কিন্তু দিনশেষে কোনো এক অদৃশ্য কারণে অপরাধীরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আজ সন্ত্রাসীদের এতটাই হিংস্র ও বেপরোয়া করে তুলেছে যে, তারা এখন টেলিভিশন চ্যানেলের একজন ব্যুরো প্রধানকে রাস্তায় ফেলে পেটাতেও দ্বিধা করে না। তারা জানে, কিছুই হবে না। এই জানাটাই তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

মাঠের সাংবাদিক হিসেবে আমাদের প্রশ্নগুলো খুব সাধারণ এবং সরাসরি। আমরা চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার এবং জেলা পুলিশ সুপার মহোদয়কে জিজ্ঞেস করতে চাই, যে সন্ত্রাসীদের নাম-পরিচয় আপনাদের অজানা নয়, তাদের গ্রেপ্তার করতে এত গড়িমসি কেন? চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশের এখতিয়ারের দোহাই দিয়ে আর কতকাল এই অপরাধের স্বর্গরাজ্যকে ছাড় দেওয়া হবে? এই সমন্বয়ের দায়িত্বটি কে নেবে? আমরা, যারা প্রতিদিন খবর সংগ্রহের জন্য শহরের অলিগলি থেকে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে বেড়াই, এই ‘এখতিয়ারের’ অজুহাত আমাদের কাছে অর্থহীন এবং প্রহসনমূলক মনে হয়। আমরা জানতে চাই, এই সন্ত্রাসীরা কি এতটাই শক্তিশালী যে রাষ্ট্র তাদের কাছে অসহায়, নাকি কোনো প্রভাবশালী ছাতার নিচে তারা সুরক্ষিত, যে ছাতা ভেদ করার সদিচ্ছা আপনাদের নেই?

যখন খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাদের ভাই-বোনেরা রক্তাক্ত হয়, যখন বুলেট বা লাঠির ভয় নিয়ে আমাদের মাঠে নামতে হয়, তখন বুঝতে হবে শুধু সাংবাদিকতা নয়, পুরো সমাজই আসলে অন্ধকারের দিকে হাঁটছে। একটি এলাকাকে যখন গণমাধ্যমের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ করে তোলা হয়, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষের কান্না, বঞ্চনা আর আর্তনাদের খবরগুলো চিরতরে চাপা পড়ে যায়। আমরা পাঠকের চোখ ও কান। আমাদের পথ রোধ করা মানে পুরো সমাজকে সত্য থেকে বঞ্চিত করা।

কাজেই, এখন আর শুধু নিন্দা জানিয়ে বসে থাকার সময় নেই। আমরা আমাদের সহকর্মী হোসাইন জিয়াদ ও মো. পারভেজের ওপর হামলাকারী প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় দেখতে চাই। তবে আমাদের চূড়ান্ত দাবি শুধু বিচারেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা চাই, জঙ্গল সলিমপুর নামক এই বিষফোঁড়াটির স্থায়ী অপসারণ। সেনাবাহিনী, র‍্যাব ও পুলিশের সমন্বিত অভিযানে এই ভূখণ্ডকে সন্ত্রাসমুক্ত করা হোক।

আমাদের সহকর্মীর শরীর থেকে ঝরা প্রতিটি রক্তবিন্দু আজ রাষ্ট্রের বিবেকের কাছে এক একটি প্রশ্ন। এই প্রশ্নের জবাব শুধু আশ্বাস দিয়ে হবে না, কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে দিতে হবে। সন্ত্রাসীরা আমাদের ক্যামেরা ভাঙতে পারে, আমাদের শরীর রক্তাক্ত করতে পারে, কিন্তু সত্য তুলে ধরার প্রত্যয়কে দমাতে পারবে না। এই লড়াই শুধু আমাদের আহত দুই সহকর্মীর জন্য নয়, এই লড়াই আমাদের সকলের পেশাগত অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আমরা আবারও জঙ্গল সলিমপুরে যাব, সত্য তুলে ধরবই।

এই প্রত্যয় আমাদের ধারণ করতেই হবে, কেননা আমাদের ভাই হোসাইন জিয়াদ এবং মো. পারভেজের শরীর থেকে ঝরা রক্ত আসলে রাষ্ট্রেরই রক্তক্ষরণ। এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে না পারলে আমাদের গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নামক ধারণাটিই অর্থহীন হয়ে পড়বে। সাংবাদিক সমাজ দমে যাবে না, সত্যের মশাল জ্বালিয়ে রাখবে। এখন রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, নাকি সন্ত্রাসীদের হাতে একটি ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার জানান দেবে।

লেখক : প্রধান প্রতিবেদক, একুশে পত্রিকা।