বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

আনোয়ারায় সনদ ছাড়াই শিশুদের ‘ডাক্তার’, দেখার কেউ নেই?

‘অভিজ্ঞতা’র দোহাই দিয়ে চিকিৎসা, শত শত শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে
জিন্নাত আয়ুব | প্রকাশিতঃ ১৬ অক্টোবর ২০২৫ | ৬:৫৩ অপরাহ্ন


চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারশত ইউনিয়নের কালিবাড়ির মোড়। এখানে নামবিহীন একটি ফার্মেসির পেছনে ছোট্ট একটি কক্ষে বসে আছেন সুজন নাথ। তার সামনে ভিড় করেছে কফ, কাশি আর জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে আসা উদ্বিগ্ন মায়েরা। বাইরে রোগীদের সিরিয়াল সামলাচ্ছেন ফার্মেসির মালিক মোহাম্মদ সেলিম। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি সাধারণ গ্রামের ডাক্তারের চেম্বারের চিত্র।

তবে এই দৃশ্যের গভীরে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা। সুজন নাথ এমবিবিএস পাশ করা কোনো চিকিৎসক নন, শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। তবুও বছরের পর বছর ধরে তিনি নিজেকে ‘শিশু রোগ অভিজ্ঞ’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে চালিয়ে যাচ্ছেন তার চিকিৎসা বাণিজ্য।

সম্প্রতি সরেজমিনে সেই বেনামি ফার্মেসিতে গিয়ে দেখা যায় এই কথিত ডাক্তারের রমরমা বাণিজ্য। রোগীদের ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে সুজন নাথের। তার চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে ফার্মেসির মালিক মোহাম্মদ সেলিমের এক ধরনের আত্মবিশ্বাস চোখে পড়ে। যখন মোহাম্মদ সেলিমকে প্রশ্ন করা হয়, সুজন নাথ কি শিশু বিশেষজ্ঞ? তিনি চতুরতার সাথে উত্তর দেন, “এখানে কোথাও কি লেখা আছে উনি শিশু ডাক্তার?”

এমবিবিএস পাশের বিষয়ে জানতে চাইলে তার একই ধরনের জবাব, “সেটাও লেখা নাই। উনি শিশু রোগ অভিজ্ঞ। বড় বড় শিশু ডাক্তারের সাথে থাকতে থাকতে একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে, তাই শিশু রোগী দেখেন।” মোহাম্মদ সেলিমের কথায় যুক্তি খোঁজার চেষ্টা চলে, “ওনার কাছে চিকিৎসা নিয়ে রোগী ভালো হয়, তাই তো রোগীর ভিড় দেখছেন না?” এক পর্যায়ে তিনি এই প্রতিবেদককে চা পানের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান।

এই চিকিৎসার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সুজন নাথ প্রথমে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, “আমি ডাক্তার পরিচয় দিই না। আমার অভিজ্ঞতা আছে তাই রোগী দেখি। রোগীর অভিভাবকরা আমার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট তাই আসে।” নিজের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে তিনি স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মীর নাম উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্কের দাবি করেন। সুজন নাথ বলেন, “দেখেন আমার দ্বারা তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আমি ডিপ্লোমা করে রোগী দেখতে বসেছি।”

কিন্তু তার এই ‘অভিজ্ঞতা’ আর ‘ডিপ্লোমা’ হাজারো শিশুর জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। গ্রামের মানুষের সচেতনতার অভাব এবং চিকিৎসক সংকটের সুযোগ নিচ্ছেন সুজন নাথের মতো মানুষেরা।

বোয়ালিয়া গ্রাম থেকে সন্তানকে নিয়ে আসা তানিয়া নামের একজন মা বলেন, “ওনিতো শিশু ডাক্তার। অনেকদিন ধরে এখানে রোগী দেখেন। সবাই ভালো বলে, তাই আমিও আমার শিশু ছেলের কফ, কাশি, জ্বর দেখাতে আসলাম।” সুজন নাথের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তার কাছে সুজন নাথ কেবলই একজন ‘শিশু ডাক্তার’, যার ওপর ভরসা করে তিনি তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে এসেছেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, এই ধরনের কথিত চিকিৎসকদের কারণে জনস্বাস্থ্য এক ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। রোগের প্রাথমিক অবস্থাতেই তারা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করছেন, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এতে রোগ নিরাময়ের বদলে আরও জটিল আকার ধারণ করছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা তাদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে।

এ বিষয়ে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিরিটি প্রসাদ দেব বলেন, “শিশু বিশেষজ্ঞরা শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে নবজাতক বা জটিল রোগে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। অনভিজ্ঞ হাতে চিকিৎসা শিশুদের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।”

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মাহাতাব উদ্দীন চৌধুরী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “শিশু ডাক্তার না হয়ে এভাবে শিশু রোগী দেখা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং ঝুঁকিপূর্ণ। আমি বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাব এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করব।”

আনোয়ারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তারকে এ বিষয়ে অবগত করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

ততদিন পর্যন্ত সুজন নাথেরা গ্রামের মানুষের বিশ্বাস আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের চিকিৎসা নামক বাণিজ্য চালিয়ে যাবেন। আর তানিয়ার মতো মায়েরা তাদের সন্তানদের আরোগ্য লাভের আশায় এমন ‘অভিজ্ঞ কসাইদের’ হাতেই তুলে দিতে থাকবেন তাদের ভবিষ্যৎ।