
তীর ভাঙার আতঙ্ক প্রতি বর্ষায় তাড়া করে ফেরে কক্সবাজারের চকরিয়ার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে। যে মাতামুহুরী নদী একসময় ছিল তাদের জীবন-জীবিকার প্রধান আশীর্বাদ, সেই নদীই এখন যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময়ের খরস্রোতা এই নদী আজ পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলি আর বালুতে দম বন্ধ হয়ে মরা খালে পরিণত হওয়ার পথে। নদীর বুকে জেগে ওঠা শতাধিক ছোট-বড় ডুবোচর জানান দিচ্ছে ভয়াবহ নাব্যতা সংকটের। তাই পরিবেশ সচেতন মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই এখন এই নদীর টেকসই শাসন ও সংরক্ষণের জোরালো দাবি তুলেছেন।
চকরিয়া উপজেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ সেই সোনালী দিনের কথা স্মরণ করেন। তিনি জানান, এই মাতামুহুরী একদিন বারো মাস মিঠা পানির জোগান দিয়ে কৃষকের গোলা ভরাতো, সেচ সুবিধা দিতো। নদীতে ছিল দেশীয় সুস্বাদু মাছের অভয়াশ্রম, চলতো সারি সারি নৌকা, পরিবাহিত হতো কাঠ ও বাঁশ। কিন্তু এক দশকের ব্যবধানে সেই চিরযৌবনা নদী আজ মৃত্যুপ্রায়।
মাহমুদুর রহমান মাহমুদ এই নদীর সুদিন ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে পরিকল্পিত ও টেকসই প্রকল্প গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এবং ড্রেজিংসহ নদী শাসনে জোর দিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বান্দরবানের লামা উপজেলার মাইভার পর্বত থেকে শুরু হয়ে এই নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। প্রায় ২৮৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর গভীরতা দুই দশক আগেও ৩০-৪০ ফুট থাকলেও এখন তা ঠেকেছে তলানিতে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এর মূল কারণ উজানে পার্বত্য লামা-আলীকদমে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বাঁশ কাটা, পাহাড়ে জুমচাষ এবং ঝিরি খুঁড়ে ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন। এসবের ফলে ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড়ের মাটি ঢলের সঙ্গে সোজা এসে পড়ছে নদীর বুকে, তিলে তিলে ভরাট করে ফেলছে এর তলদেশ।
এই পলি জমার ফল দ্বিবিধ ও ভয়াবহ। শুষ্ক মৌসুমে নদীর বুকে চর জেগে থাকায় নৌকা চলাচল প্রায় বন্ধ। খেয়া পারাপারও দুরূহ হয়ে পড়ে। মৎস্য ভান্ডার বিলুপ্ত হওয়ায় মাছ আহরণে নিয়োজিত জেলে পরিবারগুলোতে চরম উৎকণ্ঠা ও হতাশা দেখা দিয়েছে। আবার বর্ষায় অল্প বৃষ্টিতেই উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি ধারণ করতে না পেরে নদী ফুঁসে ওঠে। প্লাবিত হয় লোকালয়, বাড়ে জনদুর্ভোগ।
কিন্তু দুর্যোগের শেষ এখানেই নয়। বন্যার ধকল কাটতে না কাটতেই শুরু হয় নদীর দুই তীরের ভয়াবহ ভাঙন তাণ্ডব। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, বেড়িবাঁধ—সবই গিলে খায় আগ্রাসী মাতামুহুরী। চকরিয়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর মুজিবুল হক মুজিব তাই আক্ষেপ করে বলেন, যে নদী জনগণের জন্য আশীর্বাদ ছিল, তাই এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই সংকট নিরসনে যে চেষ্টা হয়নি তা নয়। ২০১৫ সালে চকরিয়ায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে এসে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নদী ড্রেজিংয়ের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের আলোকে ২০১৮ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ৬ কোটি টাকা বরাদ্দে একটি পাইলট প্রকল্পও গ্রহণ করে। চকরিয়ার বেতুয়াবাজারস্থ নদীর ৩ কিলোমিটার পয়েন্টে ড্রেজিং কাজ শুরুও হয়। কিন্তু এক বছর পর অজ্ঞাত কারণে সেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সাত বছর ধরে মাতামুহুরী নদী ড্রেজিং প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই, জনগণের দুর্ভোগও লাঘব হয়নি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাতামুহুরী ব্রীজের চিরিঙ্গা পয়েন্ট থেকে উজানে মানিকপুর-সুরাজপুর এবং নীচে বেতুয়া বাজার থেকে পালাকাটা রাবার ড্যাম পর্যন্ত পলি অপসারণে নতুন করে ড্রেজিংয়ের দাবি করেছেন।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মকছুদুল হক ছুট্টু বলেন, বিগত সময়ে অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণেই নদীর এই দশা। এই যৌবন ফেরাতে হলে নদী খননে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তিনি সতর্ক করেন, দ্রুত নদী শাসনে নামা না গেলে আগামী বর্ষায় ফের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
বর্তমানে মাতামুহুরী নদী শাসন ও উন্নয়নের দায়িত্বে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি ডিভিশন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ (বান্দরবান) এর নির্বাহী প্রকৌশলী অরুপ চক্রবর্তী বলেন, মাতামুহুরী নদীর ড্রেজিং ও বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য জাপানি সংস্থা ‘জাইকা’ একটি সমীক্ষা প্রকল্পের কাজ করছে। জাইকা থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা পেলে তা সরকারের কাছে পাঠানো হবে।
অপরদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার-১ এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডি) মোঃ জামাল মুর্শিদ আশাবাদী, জাইকার সমীক্ষার আলোকে পরিকল্পিত ও টেকসই উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন হলে আগামীতে নদী ভাঙন ও নাব্যতা সংকট কেটে যাবে এবং বন্যার দুর্যোগ থেকে চকরিয়ার জনসাধারণ স্থায়ীভাবে পরিত্রাণ পাবে।