
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় বিদেশী অপারেটর নিয়োগে তোড়জোড় শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাভজনকভাবে পরিচালিত এবং হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আধুনিকায়ন করা এই টার্মিনালটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অথচ ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল (থার্ড টার্মিনাল) পরিচালনায় বিদেশী অপারেটর নিয়োগের আলোচনা দুই বছর ধরে চললেও এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকারের এই অবস্থানে দেশের সার্বভৌমত্ব, কর্মসংস্থান ও আর্থিক ক্ষতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবী ও বিভিন্ন সংগঠন।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশী বিনিয়োগ ও সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশী অপারেটর নিয়োগ প্রয়োজন। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালু চারটি টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এনসিটি টার্মিনালটিতে জেটি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনাসহ বিভিন্ন খাতে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। আগামী দুই দশকে নতুন করে এ টার্মিনালে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। এটি বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেই পরিচালনা করতে পারে। বন্দরের সবচেয়ে বেশি আয়, প্রায় ৫৫ শতাংশ হ্যান্ডলিং, এনসিটি টার্মিনাল থেকে হয়। তাই এটি বিদেশী অপারেটরদের হাতে ছেড়ে দিলে বন্দরের আর্থিক ক্ষতি হবে।
এর আগে এনসিটি পরিচালনা করত দেশীয় অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। গত ৬ জুলাই চুক্তি শেষ হওয়ায় বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেডকে এটি পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এনসিটি ও লালদিয়া এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনাল বিদেশী অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।
সীকম গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিরুল হক বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো টার্মিনাল বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না—বন্দর ব্যবহারকারীরা এমনটা কখনো বলছে না। বরং আমরা বলছি যে পুরোপুরি সরকারের অর্থায়নে এনসিটির মতো সাজানো একটা টার্মিনালে কেন বিদেশী অপারেটর যুক্ত হতে হবে? …বরং বে-টার্মিনালসহ রাষ্ট্রের অর্থায়ন হয়নি, যন্ত্রপাতি ব্যয় করা হয়নি, সেখানে বিদেশী অপারেটর আনা যেতে পারে।”
বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্দর পরিচালনায় দক্ষতা শুধু অপারেটরের ওপর নির্ভর করে না। কাস্টমস প্রক্রিয়া একটি বড় বিষয়। এনবিআরের ২০২২ সালের টাইম রিলিজ স্টাডি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের মাধ্যমে পণ্য খালাসে গড়ে সময় লাগে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা। ফলে কাস্টমস প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হলে এখানে অপারেটরের কিছু করার থাকে না।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমাদের দেখতে হবে যে কীভাবে আমরা সবচেয়ে বেস্ট টার্ন অ্যারাউন্ড করতে পারি। …আমাদের প্রায় দেড়শ বিলিয়ন ডলারের ওপরে বাণিজ্য। এ ভলিউমের জন্য যে পরিমাণ কার্গো আমাদের হ্যান্ডলিং করার প্রয়োজন সেটার জন্য কাস্টমস ও পোর্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে কনভার্জ করা দরকার, সেই কনভার্জেন্সে আমাদের অভাব রয়েছে। এটা নিশ্চিত করা গেলে বন্দরের দক্ষতা ও গতিশীলতা অনেক বাড়ার সুযোগ রয়েছে।”
বন্দর ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করছেন, বিদেশী অপারেটরদের সুবিধা করে দিতে বন্দরের মাশুল বাড়ানো হয়েছে। পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “৮৬ টাকার ডলার বেড়ে এখন ১২০ টাকায় ঠেকেছে। বন্দরের মাশুল আদায় হয় ডলারের হিসাবে।”
অন্যদিকে, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে ‘সফট ওপেনিং’ হলেও অপারেটর নিয়োগ চূড়ান্ত হয়নি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) জাপানের একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা চললেও অন্তর্বর্তী সরকার গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে দেওয়ায় জাপানিরা ক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছে কয়েকটি সূত্র। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, জাপানি কনসোর্টিয়াম এখন চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আগ্রহী।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক গত মাসে জানিয়েছিলেন, জাপানি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে থার্ড টার্মিনালের চুক্তি মূলত রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনায় আটকে রয়েছে।
এ বিষয়ে উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ হয়েছে। এর জন্য তো প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থের ডেট সার্ভিসিং করতে হবে। …এয়ারপোর্টের ক্ষেত্রে আমাদের আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। …জিটুজির পরিক্রমাটা শেষ করেই আমরা নতুন কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের ব্যবস্থাপনায় দেয়া কতটা সঠিক সেটা ভিন্ন আলোচনা। …চলমান বন্দরটিই আমরা নিজেদের ব্যবস্থাপনা থেকে অন্য ব্যবস্থাপনায় দিতে চাচ্ছি। স্পর্শকাতর একটা জায়গা আমি অন্য কাউকে দেব কি দেব না, কী শর্তে দিচ্ছি, সিকিউরিটির বিষয়টি কী, …এ ধরনের বিষয় নিয়ে ভিন্ন বিতর্ক হতে পারে।”
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক পর্ষদ সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কর্মযজ্ঞ রয়েছে। এ জায়গা খুবই ক্যাপিটাল ইনটেনসিভ। যথাযথ বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে বন্দরের সক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। …সরকার মনে করেছে বিদেশী ব্যবস্থাপনায় বন্দর অপারেট করা গেলে পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা সম্ভব হবে।”
দুটি বন্দর নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো ঘাটতি নেই বলে দাবি করেছেন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, “বিমান ও সমুদ্র—দুই বন্দর নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বৈসাদৃশ্য বা ঘাটতি আমি দেখি না। কিন্তু পদ্ধতিগত বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করাও তো সম্ভব না। বিশেষ করে যখন বিষয়গুলো সরকার থেকে সরকার পর্যায়ে হয়, তখন উপেক্ষা করা সম্ভব না।”