বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরও কেন অপ্রস্তুত কক্সবাজার বিমানবন্দর?

এয়ারলাইন্স অনাগ্রহী, ব্যবসায়ীরা হতাশ; কার স্বার্থে আইকাও’র শর্ত পূরণ না করেই ‘আন্তর্জাতিক’ ঘোষণা?
একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১ নভেম্বর ২০২৫ | ৭:৪১ পূর্বাহ্ন

Cox's Bazar Airport
স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। কথা ছিল, বিশ্বের পর্যটকরা সরাসরি নামবেন সাগরপাড়ের এই বিমানবন্দরে। সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে ‘আন্তর্জাতিক’ ঘোষণাও এসেছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্থায়ী হলো মাত্র ১১ দিন। দুর্বল ফায়ার সেফটি, অসম্পূর্ণ টার্মিনাল আর অপ্রস্তুত অবকাঠামোর রূঢ় বাস্তবতায় হোঁচট খেল কক্সবাজার বিমানবন্দর। তড়িঘড়ি করে দেওয়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আকস্মিকভাবে স্থগিত করেছে সরকার।

প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এই বিশাল প্রকল্পে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) শর্তই পূরণ হয়নি। অথচ ‘জোর করেই’ দেওয়া হয়েছিল স্বীকৃতি। এই আকস্মিক পিছু হটা এখন সরকারের পরিকল্পনাহীনতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা পর্যটন ব্যবসায়ী এবং এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের হতাশ করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক ঘোষণা করতে হলে যে মৌলিক প্রস্তুতি দরকার, তার প্রায় কিছুই সম্পন্ন হয়নি কক্সবাজারে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অব.) এটিএম নজরুল ইসলাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, আন্তর্জাতিক মানের জন্য ফায়ার সেফটি, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস এবং কার্গো পরিবহনের যে পৃথক ব্যবস্থা অপরিহার্য, তা নিশ্চিত না করেই এই ঘোষণা ছিল অদূরদর্শী।

জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের পর যখন নিরাপত্তা অবকাঠামো পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখনই কক্সবাজারের প্রস্তুতির ঘাটতি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। ঝুঁকি এড়াতে তাই তড়িঘড়ি করে এই স্থগিতাদেশ।

ভেতরের চিত্র আরও হতাশাজনক। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন, আন্তর্জাতিক টার্মিনালই প্রস্তুত নয়। কনভেয়র বেল্ট বসেনি, লাইটিং, ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার প্রটেকশন—এমনকি সাইনবোর্ডের কাজও বাকি। লাগেজ স্ক্যানিং মেশিন ও মেটাল ডিটেক্টর এখনো এসে পৌঁছায়নি। এই কাজ সম্পূর্ণ করতে আরও অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যাবে।

বেবিচকের সদস্য ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন (এফএসআর) মুকিত উল আলম মিয়া স্বীকার করেছেন যে, তারা “অনেকগুলো লিমিটেশনসহ সার্টিফিকেশন” করেছিলেন। যেমন, বোয়িং ৭৩৭ ধরনের বিমানের জন্য আইকাও মানদণ্ড অনুযায়ী যে দুটি ফায়ার ফাইটিং যান বাধ্যতামূলক, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ‘আন্তর্জাতিক’ ঘোষণার আগে সরকার এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। ফলে কোনো দেশি বা বিদেশি বিমান সংস্থা কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহই দেখায়নি। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম প্রশ্ন তুলেছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরও কেন আন্তর্জাতিক মান স্থগিত হলো?

সরকারের এই সিদ্ধান্তে পর্যটন ব্যবসায়ীরা আশাহত। ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সফিউল আলম কাজল বলেন, ঘোষণার পর তারা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত ছিলেন, কিন্তু আকস্মিক স্থগিতাদেশ পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মোচনের সম্ভাবনাকে থামিয়ে দিয়েছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদস্য (এটিএম) নূর-ই-আলম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন। আপাতত কক্সবাজার বিমানবন্দরে কোনো আন্তর্জাতিক শিডিউল ফ্লাইট নামছে না। সব মিলিয়ে, অপরিণত এই ঘোষণা এবং ততোধিক দ্রুত স্থগিতাদেশ একটি সম্ভাবনাময় প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিল।