বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

সোনাদিয়ার বালিতে লুকিয়ে আছে ‘বিলিয়ন ডলারের’ ভবিষ্যৎ

সোনাদিয়ার খনিজে চোখ কেন বিদেশিদের?
একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১ নভেম্বর ২০২৫ | ২:০৯ অপরাহ্ন


আপনারা হয়তো কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার নয় বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়ার কথা শুনে থাকবেন। চারদিকে জলরাশি ঘেরা ম্যানগ্রোভ আর উপকূলীয় বনের এই ভূখণ্ড কেবল তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই অনন্য নয়, এর বালুকণার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে এক বিপুল খনিজ ভাণ্ডার।

সাগর যখন এই দ্বীপে আছড়ে পড়ে, তখন সে কেবল লবণাক্ত পানিই বয়ে আনে না, সাথে নিয়ে আসে ভারী প্রাকৃতিক খনিজ। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা জার্নাল ‘ডিসকভার জিওসায়েন্স’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র এই গুপ্তধনের পরিমাণ নিয়ে নতুন করে কৌতূহল তৈরি করেছে।

নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার গবেষক—মো. শাখাওয়াত হোসেন, মো. শাহরিয়ার রহমান, গোলাম তাকি ও মাফতুহা জাহান—তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, সোনাদিয়া দ্বীপে আনুমানিক সাত লাখ টন মূল্যবান খনিজ সম্পদ মজুদ রয়েছে।

এই খনিজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে গারনেট (৫১.৫২ শতাংশ) এবং ইলমেনাইট (৩৮.১৪ শতাংশ)। এছাড়া ম্যাগনেটাইট, জিরকন, রুটাইল ও মোনাজাইটের মতো মূল্যবান খনিজও পাওয়া গেছে। গবেষকরা দাবি করেছেন, দ্বীপের বালিয়াড়িতেই খনিজের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, যা সমুদ্রতীর বা তীরবর্তী এলাকার চেয়েও উল্লেখযোগ্যভাবে সমৃদ্ধ।

কেন এত মূল্যবান এই বালি?

সাধারণ বালির মতো দেখতে হলেও এই খনিজগুলো বিশ্ব শিল্পায়নের অপরিহার্য উপাদান। গারনেট হলো একটি প্রাকৃতিক ঘর্ষণজাত পণ্য (অ্যাব্রেসিভ), যা ওয়াটারজেট কাটিং, স্যান্ডব্লাস্টিং এবং পলিশিং শিল্পের প্রাণ। এমনকি পানি পরিশোধন কেন্দ্রেও এর ব্যবহার রয়েছে।

তবে আসল ‘তারকা’ হলো ইলমেনাইট। এটি টাইটানিয়াম ধাতুর প্রধান উৎস। এই ইলমেনাইট থেকে যে টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়, তার বৈশ্বিক বাজারই প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের। রঙ, প্লাস্টিক থেকে শুরু করে বিমান, মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা শিল্পে হালকা অথচ শক্ত ধাতু তৈরিতে টাইটানিয়ামের কোনো বিকল্প নেই।

একইভাবে জিরকন ব্যবহৃত হয় সিরামিক শিল্পে, আর মোনাজাইটে থাকে দুর্লভ ‘রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট’, যা আধুনিক ইলেকট্রনিকস থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির টারবাইনে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, সোনাদিয়ার এই বালি কেবল বালি নয়, এটি বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমির এক অপার সম্ভাবনা।

সাত লাখ টন: ‘বিপুল’ নাকি ‘যৎসামান্য’?

নতুন এই গবেষণা আশার আলো ছড়ালেও সরকারের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জি (আইএমএমএম) এই পরিমাণকে দেখছে ভিন্ন কোণ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আমিনুর রহমান এই সাত লাখ টন খনিজকে ‘খুবই যৎসামান্য’ বলে মনে করেন।

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৮০’র দশকে পরিচালিত এক গবেষণায় শুধু সোনাদিয়া নয়, বরং কক্সবাজার, টেকনাফ ও মহেশখালীসহ পুরো অঞ্চলে প্রায় দুই কোটি দশ লাখ টন ভারী খনিজ সম্পদের উপস্থিতির তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তার মতে, এই সম্পদ বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে আরও গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন, কারণ এটি একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

খনিজ, পর্যটন নাকি কিছুই না?

সোনাদিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন খনিজের এই পরিসংখ্যান আলোচিত হচ্ছে, তখন দ্বীপটির জন্য সরকারের পরিকল্পনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) এই দ্বীপের জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল একটি পরিবেশবান্ধব ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার জন্য। মাহিন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজও করা হয়েছিল।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে হাইকোর্ট বেজার সেই জমি বরাদ্দ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে। অন্তর্বর্তী সরকার পরে দ্বীপের জমি বন বিভাগের কাছে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়। ফলে সোনাদিয়ার ভবিষ্যৎ পর্যটন পরিকল্পনাও এখন থমকে আছে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, যখন সোনাদিয়ার সমুদ্রতটের বালি নিয়ে এত আলোচনা, তখন বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর সমুদ্র বা দ্বীপের বালি নিয়ে এখনই ভাবছে না। মহাপরিচালক মো. আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, তিনি সোনাদিয়া দ্বীপের খনিজ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অবগত নন। সরকার বর্তমানে নদীর বালি প্রক্রিয়াকরণের দিকে এগোচ্ছে। তাদের ধারণা, প্রতি বছর নদীতে আসা পলির মাত্র দশ ভাগ প্রক্রিয়া করতে পারলেই বছরে দুই হাজার কোটি টাকা আয় সম্ভব।

তাড়াহুড়ো নয়, আগে সক্ষমতা

তাহলে সোনাদিয়ার এই খনিজ সম্পদের কী হবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্ভাবনা বিপুল, কিন্তু পথটি জটিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা মিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন।

তিনি মনে করেন, সোনাদিয়ার মতো দ্বীপাঞ্চলে অবশ্যই ভারী খনিজ আছে এবং তা নিয়ে সঠিক গবেষণা প্রয়োজন। তবে তিনি জোরালোভাবে পরামর্শ দেন, এই গবেষণা যেন শুরুতেই কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানো না হয়।

তার আশঙ্কার কারণ হলো, এসব খনিজের সঙ্গে ‘রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট’ থাকার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে, যা পারমাণবিক শক্তি থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অত্যন্ত দামি এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশগুলো যা হন্যে হয়ে খুঁজছে।

ড. বদরুদ্দোজা মিয়ার মতে, এ নিয়ে কোনো তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে আমরা নিজেরাই আমাদের সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি।

সব মিলিয়ে সোনাদিয়া দ্বীপ এখন এক ত্রিমুখী বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে। একদিকে সাত লাখ টনের নতুন গবেষণার আশা, অন্যদিকে দুই কোটি টনের পুরোনো পরিসংখ্যানের বিশাল ক্যানভাস, আর এর বিপরীতে থমকে থাকা ইকো-ট্যুরিজমের পরিকল্পনা। সোনাদিয়ার বালি হয়তো সত্যিই সোনার চেয়ে দামি, কিন্তু সেই গুপ্তধন আহরণের চাবিটি এখনো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।