যখন কলম এবং ক্যামেরা না থাকে, তখন ক্ষমতার দম্ভ আর অমানবিকতার আস্ফালন ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, আনোয়ারার হাইলধরের ঘটনাটি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আর যখন সেই কলম এবং ক্যামেরা সত্যের পক্ষে দাঁড়ায়, তখন সেই দম্ভ খড়কুটোর মতো ভেসে যায়—এই ঘটনাটি তারও প্রমাণ বটে।
ঘটনাটি আমাদের লজ্জিত করে। আপন ভাই-ভাতিজা মিলে আরেক ভাইকে ‘গরু চোর’ অপবাদ দিয়ে প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে ‘সাপের মতো পিটিয়ে’ আইসিইউতে পাঠিয়ে দেবে, এটা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। কিন্তু আমাদের লজ্জিত হওয়ার পর্ব সেখানেই শেষ নয়। আমাদের লজ্জা আরও গভীর হয় যখন দেখি, এই বর্বরতার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রথম রক্ষাকবচ, অর্থাৎ পুলিশ, নিষ্ক্রিয় থাকে।
নাজিম উদ্দীন নামে যে ব্যক্তিটি হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, তার স্ত্রী মুক্তা যখন তিন সন্তানকে নিয়ে বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, তখন আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছ থেকে তিনি কী পেলেন? পেলেন ‘আদালতে যান’ নামক এক উদাসীন পরামর্শ।
ভুক্তভোগীর পরিবারের অভিযোগটি ছিল আরও গুরুতর। তাদের ভাষ্যমতে, স্থানীয় সাংবাদিক থেকে শুরু করে সবাই ‘ম্যানেজড’। টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ রাখা হয়েছে।
এই একটি বাক্য—‘সবাই ম্যানেজড’—আমাদের পুরো সিস্টেমের প্রতি এক ভয়ঙ্কর অনাস্থার দলিল। এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে, যে পুলিশকে বলা হয় জনগণের বন্ধু, সেই পুলিশের কাছে একজন মৃত্যুপথযাত্রী নাগরিকের আর্তনাদের চেয়েও ‘ম্যানেজড’ হওয়ার প্রলোভন বা চাপ বড় হয়ে দাঁড়ায়? এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে এটি শুধু একজন ওসির ব্যর্থতা নয়, এটি পুরো একটি ব্যবস্থার পচনের ইঙ্গিত দেয়।
আমরা প্রায়শই ‘নতুন বাংলাদেশ’ এবং ‘স্মার্ট পুলিশিং’-এর কথা শুনি। কিন্তু আনোয়ারার এই ঘটনা আমাদের কী শিক্ষা দিল? ভুক্তভোগীর পরিবারের এই অভিযোগ কি তবে সত্যি? ওসি মনির হোসেনের পরবর্তী আচরণ তো সেই সন্দেহকেই আরও ঘনীভূত করে।
ঘটনাটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগোলে কী হতো? একটি ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার ভিডিও ফুটেজ আছে, ভুক্তভোগী আইসিইউতে—এমন একটি ঘটনায় মামলা রুজু করা পুলিশের রুটিন দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মামলা নিলে ওসির কী এমন ক্ষতি হতো? তিনি তো বরং অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে প্রশংসিত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। কেন করেননি, সেই প্রশ্ন ভুক্তভোগীর পরিবারের তোলা ‘ম্যানেজড’ তত্ত্বের দিকেই আঙুল তোলে।
এই যখন পরিস্থিতি, যখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখনই সাংবাদিকতার আসল পরীক্ষা শুরু হয়। একুশে পত্রিকার আনোয়ারা-কর্ণফুলী প্রতিনিধি জিন্নাত আয়ুব সেই পরীক্ষায় শুধু পাস করেননি, তিনি ডিস্টিংশনসহ পাস করেছেন।
ভুক্তভোগী পরিবার যখন আর কোথাও কোনো আশ্রয় না পেয়ে, শুধু ‘সাহসী সাংবাদিক’ হিসেবে জিন্নাত আয়ুবের সুনামের ওপর ভরসা করে তার বাড়িতে ছুটে যায়, তখন জিন্নাত আয়ুব সাংবাদিকতার মূল মন্ত্রটি ভোলেননি। তার কাছেও বিকল্প ছিল। তিনি পারতেন ওসির সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। তিনি পারতেন ‘ঝামেলা’ এড়িয়ে চলতে। তদুপরি, ওসি মনির হোসেন তাকে নিউজটি না করতে অনুরোধও করেছিলেন।
কিন্তু জিন্নাত আয়ুব বিবেকের তাড়নাকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি পেশাদারিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি সরেজমিনে গেছেন, প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন, সেই ভয়াবহ পিটুনির ভিডিও জোগাড় করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নিউজটি করেছেন।
এরপর যা ঘটল, তা একাধারে স্বস্তির এবং আরও বেশি লজ্জার।
স্বস্তির কারণ, একুশে পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই যে পুলিশ এক সপ্তাহেও ‘সময়’ পায়নি, সেই পুলিশই আসামি আহমদ ছফাকে ধরতে ঘটনাস্থলে ছুটে গেছে। মামলাও রুজু হয়েছে। একেই বলে ‘পাওয়ার অফ জার্নালিজম’। একটি কলমের কালি সিস্টেমের সমস্ত জং ধরা চাকাগুলোকে এক নিমিষে সচল করে দিয়েছে।
কিন্তু লজ্জার বিষয়টি হলো ওসির প্রতিক্রিয়া।
আহমদ ছফাকে আটকের পর ওসি মনির হোসেন যে কাজটি করলেন, তা তার পেশাদারিত্বকে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে এনেছে। তিনি একুশে পত্রিকার সাংবাদিক জিন্নাত আয়ুবকে থানার অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে ‘রিমুভ’ করে দিয়েছেন।
কেন? সত্য প্রকাশ করার অপরাধে? তার নিষ্ক্রিয়তা বা সম্ভাব্য ‘ম্যানেজড’ হওয়ার বিষয়টি জনসমক্ষে এনে দেওয়ার ‘শাস্তি’ হিসেবে?
একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি জনগণের করের টাকায় বেতন পান, তিনি একটি প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের সাংবাদিককে তথ্য জানানোর অফিসিয়াল চ্যানেল থেকে বাদ দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইলেন? তিনি কি ভেবেছেন যে, জিন্নাত আয়ুবকে গ্রুপ থেকে রিমুভ করলেই একুশে পত্রিকার কণ্ঠরোধ করা যাবে?
ওসি মনির হোসেন এই শিশুসুলভ এবং প্রতিহিংসামূলক কাজটি করে আদতে নিজেকেই অপরাধী প্রমাণ করলেন। তিনি যদি স্বচ্ছ থাকতেন, যদি তার কোনো দুরভিসন্ধি না থাকত, তবে তিনি জিন্নাত আয়ুবকে ধন্যবাদ জানাতে পারতেন। বলতে পারতেন, “আপনার তথ্যের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।” কিন্তু তিনি বেছে নিলেন একনায়কতান্ত্রিক সেন্সরশিপের পথ।
আমরা ওসি মনির হোসেনের কাছ থেকে এমন অপেশাদার আচরণ আশা করিনি। আমরা আশা করি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
এই ঘটনাটি আমাদের নতুন করে কিছু প্রশ্ন ভাবতে বাধ্য করছে। নতুন বাংলাদেশের পুলিশ কি তাহলে কিছুই শিখল না? সেই পুরনো ঔপনিবেশিক মানসিকতা, সেই দম্ভ, সেই অস্বচ্ছতা—এসবই যদি রয়ে যায়, তবে উর্দি বদলানো বা হাতে নতুন প্রযুক্তি তুলে দিলেই কি ‘স্মার্ট পুলিশিং’ বাস্তবায়ন হবে?
নাজিম উদ্দীন হয়তো বেঁচে ফিরবেন, নয়তো না। কিন্তু তিনি যে সিস্টেমের শিকার হলেন, সেই সিস্টেমের অসুখ আরও গভীর। জিন্নাত আয়ুব তার কলম দিয়ে সেই অসুখে একটি শক্ত আঘাত করেছেন। যতবারই এমন আঘাত আসবে, ততবারই পুলিশ এবং সিস্টেমের ভেতর লুকিয়ে থাকা ‘ম্যানেজড’ অংশটি এভাবেই অস্থির হয়ে উঠবে।
আমরা জিন্নাত আয়ুবের সাহসিকতাকে স্যালুট জানাই। একুশে পত্রিকা সত্য প্রকাশে কোনো অনুরোধ, কোনো রক্তচক্ষু বা কোনো ‘রিমুভ’ বাটনে ভয় পায় না।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।