বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

বিএনপি-জামায়াত ‘ছাড়াছাড়ি’: জুলাই সনদ নিয়ে বিরোধে মধ্যস্থতাও ‘ব্যর্থ’

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২ নভেম্বর ২০২৫ | ১০:৫২ পূর্বাহ্ন

bnp jamaat
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যকার বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। এই অচলাবস্থা নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার ‘পর্দার আড়ালে’ সমঝোতার উদ্যোগ নিলেও তাতে কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি হয়নি। বিএনপি নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনে অনড়, অন্যদিকে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। এই রাজনৈতিক মতবিরোধের মধ্যেই দল দুটির তৃণমূল পর্যায়ে সংঘর্ষ এবং শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্য কাদা ছোড়াছুড়িতে সম্পর্ক এখন তিক্ততার চরমে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে চারজন উপদেষ্টা সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে দুই দফা কথা বলেছেন, তবে কোনো সমঝোতার ইঙ্গিত মেলেনি। সরকার এই বিরোধে বিব্রত এবং দলগুলোকে বিরোধ মেটানোর অনুরোধ জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, সরকার দুটি প্রস্তাব সামনে রেখে আলোচনা শুরু করে। বিএনপিকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন মেনে নেওয়ার এবং জামায়াতকে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট মেনে নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু উভয় পক্ষই প্রকাশ্যে তাদের অবস্থানে অনড়। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ জানান, সরকারের উপদেষ্টারা যোগাযোগ করেছেন, কিন্তু তাদের দলীয় অবস্থান হলো আগে গণভোট হতে হবে। তিনি বলেন, “এখানে আমরা কোনো ছাড় দেব না।”

অন্যদিকে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “নির্বাচনের আগে গণভোট করার আর কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে। দুটি ভোট থাকবে, একটি গণভোটের জন্য, আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য।” তিনি আরও বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন পুরো জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে।”

উপদেষ্টা পরিষদ মনে করছে, ঢাকায় বিএনপির নেতৃত্ব বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, এজন্য লন্ডনে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতি লাগবে। তাই প্রধান উপদেষ্টাকে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করা হয়েছে।

দল দুটির এই বিরোধ এমন এক সময়ে প্রকাশ্যে এসেছে যখন ২০২২ সালে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর থেকেই তাদের সম্পর্ক শিথিল হতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, সংবিধান সংস্কার ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে তাদের বিরোধ স্পষ্ট হয়।

এখন এই রাজনৈতিক বিরোধ মাঠ পর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপির মধ্যে ২০টি সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এবং অন্তত ২১৬ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। একই সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির ৩০টি সংঘর্ষে আটজনের মৃত্যু ও ৪১২ জন আহত হন। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, নোয়াখালী সদর, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বিএনপি ও জামায়াত সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

প্রকাশ্য সভা-সমাবেশেও নেতারা একে অপরের কড়া সমালোচনা করছেন। শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “আজ ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র করছে।” একই অনুষ্ঠানে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানান।

অন্যদিকে, শুক্রবার কুমিল্লায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “এতগুলো রাজনৈতিক দলের সময় নষ্ট করে সবাই যখন একটি জায়গায় পৌঁছেছে, তখনই বিএনপি সংস্কারের বিরোধিতা করছে। আমি মনে করি, এটি বিএনপির দায়িত্বহীনতার পরিচয়। বিএনপি পরিকল্পিতভাবে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতির যে ট্রান্সফরমেশন, এটা নতুন করে হচ্ছে। এই রূপান্তরে দেখা গেছে, এখানে বিএনপিও ক্ষমতায় আসতে চায়। আবার জামায়াতও। ফলে ইন্টারনালি এখানে নতুন করে একটা ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।” তিনি বলেন, জুলাই-পরবর্তী সময়ে সহিংসতার ধরন পরিবর্তন হচ্ছে এবং দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সম্পর্কের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।