
ডান হাতের লিগামেন্ট ছেঁড়া। মেরুদণ্ডে তীব্র ব্যথা। হাঁটুর গুরুতর চোট উপশমে চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ—পূর্ণ বিশ্রাম। কিন্তু মফিজুর রহমান আশিক সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে ছুটে চলেছেন চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে। তার কাঁধে এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের ৩১ দফা বাস্তবায়নের ভার, আর লক্ষ্য ধানের শীষের প্রচার।
এই শারীরিক ক্ষতগুলো কোনো দুর্ঘটনার চিহ্ন নয়। আশিকের ভাষ্যমতে, এগুলো শেখ হাসিনার শাসনামলে দুই দফা গুম ও রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের সাক্ষী।
স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই মেধাবী ছাত্র। তিনি জানান, ২০১৩ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ৫ ডিসেম্বর রাতে মিরপুর মুসলিম বাজার থেকে তাকে কালো মাইক্রোবাসে তুলে নেয় সরকারি বিশেষ বাহিনী। অজ্ঞাত স্থানে চোখ বেঁধে দুই মাস গুম করে রাখা হয়।

নির্যাতনের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মফিজুর রহমান আশিক বলেন, “বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়ে আমি ২০১৩ ও ২০২২ সালে দুইবার গুমের শিকার হয়েছি। ‘আয়নাঘর’-এর মতো ভয়ংকর স্থানে বন্দী ছিলাম। ইলেকট্রিক শক, উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর—এসব নির্যাতনে আমার হাতের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে, কোমর ও হাঁটু ভেঙে দিয়েছিল। ঝুলিয়ে পেটানোর কারণে মেরুদণ্ডে গুরুতর ক্ষত হয়েছে। বিএনপি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো পাশে না থাকলে হয়তো আজ আমি বাঁশখালীর মানুষের জন্য কাজ করতে পারতাম না।”
দ্বিতীয়বার তিনি গুম হন ২০২২ সালের ১৪ অক্টোবর। সেবার সিটিটিসি তাকে তুলে নেয়। আশিকের অভিযোগ, তথাকথিত “জঙ্গি নাটক মঞ্চায়ন”-এর ভিডিও ও ছবি বিদেশি মানবাধিকার সংস্থায় পাঠানোর অভিযোগে তাকে দুই দিন গুম রেখে রাষ্ট্রদ্রোহ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার দেখানো হয়। নয় মাস কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান।
আশিক জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শুরু থেকেই তিনি মানবাধিকার কর্মী ও ছাত্র সমন্বয়কদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “১৬ জুলাই রাতে আন্দোলন স্থগিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে আমি এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনকে দিয়ে ১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণার পরামর্শ দিই। এরপর আসিফ মাহমুদ ও হান্নান মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই।”
তিনি আরও দাবি করেন, “২ আগস্ট ছাত্র সমন্বয়করা মুক্তি পাওয়ার পর এক দফা ঘোষণার পরামর্শ দিই এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের নাম নিয়ে আলোচনা করি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আমি ও ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী ছাত্র সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদকে ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই।”

গত ১৭ বছর ধরে আন্দোলনে সক্রিয় থাকা আশিক এখন বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে বাঁশখালী থেকে নির্বাচন করতে আশাবাদী।
স্থানীয় নেতারাও তার এই ত্যাগকে মূল্যায়ন করছেন। ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক নির্বাহী সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, “গুমফেরত আশিক ভাই ১৭ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আমরা তাকে বাঁশখালীর মানুষের সেবায় নিয়োজিত হতে বললে তিনি রাজি হন। এখন তিনি ৩১ দফা প্রচারে মাঠে আছেন, মানুষ তাকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায়।”
একই সুরে কথা বললেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. আশেক উল্লাহ। তার মতে, “তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়নে বাঁশখালীতে আশিক ভাইয়ের বিকল্প নেই। ত্যাগ, সংগ্রাম ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা তাঁকে তরুণ প্রজন্মের অনুপ্রেরণায় পরিণত করেছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্যাতনের স্থায়ী ক্ষত শরীরে নিয়েও মফিজুর রহমান আশিকের এই রাজনৈতিক অধ্যবসায় তাকে বাঁশখালীর তরুণ প্রজন্মের কাছে এক জীবন্ত প্রতীকে পরিণত করেছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি তিনি বিএনপির মনোনয়ন পান, তবে চট্টগ্রাম-১৬ আসনের এই লড়াইটি কেবল একটি নির্বাচন থাকবে না; এটি হয়ে উঠবে ত্যাগ বনাম দমননীতির এক প্রতীকী প্রতিদ্বন্দ্বিতা।