ইকবাল মাহমুদ, কোলকাতা থেকে ফিরে : ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে পরিচয় অভিজিৎদার সঙ্গে। তিনি সপরিবারে বেড়াতে গেছেন, আমি একা। ক্যাবল ট্রেনের টিকেট কাটতে গিয়ে তার সহযোগিতা চাওয়া এবং পরিচয়। মিতভাষি, কিন্তু খুব আমোদে মানুষ। চারদিনের সিঙ্গাপুর ভ্রমণে তিনি দুবেলা খাইয়েছেন আমাকে। বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর বিপুল কৌতূহল, কিন্তু কখনও আসা হয়নি এ বাংলায়। চারদিন পর আমি বাংলাদেশে ফিরি, তিনি পশ্চিমবঙ্গে। বীরভূমের বোলপুরে অভিজিৎদার বাড়ি। বড় ব্যবসায়ী। তাঁর স্ত্রী বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন-এর গণসংযোগ বিভাগের বড়কর্তা।
ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে অভিজিৎ দা সংযোগ রাখেন। গত মাসে হুট করে নিমন্ত্রণ করলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে যাও’। একটা দারুণ উপলক্ষের কথাও জানালেন। শান্তিনিকেতন-এর সমাবর্তন। আমি আনন্দে লাফিয়ে ওঠলাম। ভারতের ভিসা আগেই করা ছিলো। রোজার পরে কোলকাতা যাওয়ার প্ল্যান করে রেখেছিলাম। কিন্তু এমন আকস্মিক নিমন্ত্রণে সফরটি এগিয়ে আনলাম। ২৫ মে সমাবর্তন। একইদিন শান্তিনিকেতন ক্যম্পাসে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এটি উদ্বোধন করবেন। একটির সঙ্গে আরেকটি ফ্রি। সুযোগটা হাতছাড়া করা যায় না।
২২ মে সন্ধ্যায় কোলকাতার দমদম এয়ারপোর্টে (নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোস বিমানবন্দর) নামলাম। টেক্সি নিয়ে সোজা মারকুইস স্ট্রিটের হোটেল রয়েল প্লাজায়। রাতের কোলকাতা দেখতে বের হলাম, সাথে আরেক সহকর্মী নূরুল ইসলাম। রোজার মধ্যে কোলকাতায় কেন, এমন খেদুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন যারা করেছিলেন তাঁদের জন্য একটা ভালো জবাব পেয়ে গেলাম। কোলকাতায় প্রায় ৩৪ শতাংশ মুসলমান বাস করেন। রমজানের প্রতিরাত তাঁদের জন্য ঈদের রাতের মত। পাড়ায় পাড়ায় রাতভর ছেলেরা সড়কে ক্রিকেট খেলে উৎসবে মাতে। সেহেরীর সময় হলে সেহেরী সেরে ঘুমোতে যায়।
সেহেরীর খাবার কেনার জন্য একটি হোটেলে গেলাম। সেখানেও অপার মুগ্ধতা আমাদেরকে আচ্ছন্ন করলো। রমজান উপলক্ষে প্রতিটি খাবার আইটেমে বিশেষ মূল্যছাড়ের ঘোষনা টানানো আছে। তরুণ হোটেল-মালিক আরাফাতের সঙ্গে কথা হলো। তার ভাষায় ‘ ১১ মাস টাকা কামাই, আর রমজানে মানুষের দোয়া কামাই’। আমার চোখ ছলছল করতে লাগলো। আহারে! আমার দেশে রমজান এলেই একশ্রেণীর ব্যবসায়ী দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামে। আর রোজাদারদের ভেজাল পণ্য খাইয়ে কম সময়ে বেশি টাকা বানানোর নেশায় মেতে ওঠে। এনিয়ে কত লেখালেখি, কত টকশো হয়। কিন্তু ওই অসাধু চক্রের লাগাম ধরবে কে?
ফেসবুকে পোস্ট দেখে একাত্তরের সহকর্মী রাজিব হাসান যোগাযোগ করলেন। পরদিন গুগল লোকেশনের সহায়তায় সোজা আমার রুমে পৌঁছে গেলেন রাজিব, সাথে তার কলেজ শিক্ষিকা সহধর্মিণীও। সারাদিন সময় দিলেন রাজিব দম্পতি, আমরা নানা জায়গায় ঘুরলাম। বিশেষ করে বড়বাজারে শপিং করতে গিয়ে ভাবী কমদামে ভালো জিনিস বেছে দিতে বহু কষ্ট করেছেন। রাতেও ঘুরলাম কোলকাতা শহরে। বাংলাদেশী ভিজিটরদের বহুল পরিচিত ’দাওয়াত’ হোটেলে রাতের খাবার খেতে গিয়ে দেখা স্মারক ভাইয়ের সাথে। মাহবুব স্মারক, একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি। প্রধানমন্ত্রীর নিউজ কভার করতে তিনি এসেছেন।
পরদিন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রায় পৌনে চারঘণ্টার ট্রেনজার্নি করে পৌঁছলাম বীরভূমের বোলপুর পৌরসভায়। আমি ইন্ডিয়ার সিম নেইনি। তাই অভিজিৎদা আমাকে ফোনে পাচ্ছেন না। বোলপুর স্টেশনে নেমে মোবাইলে ওয়াইফাই ডাটা সংযুক্ত হতেই দেখি ইনবক্সে অভিজিৎদার ক্ষুদেবার্তা। ‘ঘরে বাইরে’ নামে একটি রিসোর্টের ঠিকানা দিয়ে ওখানে চলে যেতে বলেছেন। আমরা ওখানে যেতে যেতেই ইফতারের সময় হলো, সাদা ভাত, সবজি আর ডাল দিয়ে ইফতার করলাম। কিছুক্ষণ পর কালো এলিয়েনে চড়ে এলেন অভিজিৎদা। পরম মমতায় বুকে টেনে নিলেন। ঘন্টা-খানেক সেখানে চা-কফির আড্ডা, হৈ-হুল্লোড়শেষে আমাদের নিয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনের গেস্ট হাউজে। ওখানে আগেই আমাদের রুম বুকড করে রেখেছেন।
আলীশান গেস্ট হাউজ, সবখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া আছে। একটা ব্যাপার খুব লক্ষ করলাম, শান্তিনিকেতন ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সবখানে রবীন্দ্রনাথকে মানুষ দেবতাজ্ঞান করে। বহু বাড়ি-ঘরের সামনে রবীন্দ্রনাথের ম্যুরাল স্থাপণ করা দেখেছি। রাতে শান্তি নিকেতন ক্যম্পাস ঘুরতে গিয়ে অপরিসীম মুগ্ধতায় চোখ আটকে গেছে। বাংলাদেশ ভবনে গেলাম। সেখানে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত, দম ফেলার ফুরসত নেই দূতাবাসের কর্মকর্তাদের। পরদিন অনুষ্ঠানের জন্য সিকিউরিটি পাস সংগ্রহ করতে বেশ বেগ পেতে হলো। অবশেষে পাওয়া গেলো সিকিউরিটি পাস। কিন্তু পাসকার্ডের পেছনের পাতায় যেসব শর্ত লেখা দেখলাম তাতে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মোবাইল, ক্যামেরা, রেকর্ডার, চাবি, ব্রেসলেট, ঘড়ি, আংটি, এমনকি কলম, মানিব্যাগও সাথে নেয়া যাবে না। আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে ভারত সরকারের এমন বাড়তি আয়োজনে আশ্বস্তই হলাম।
রাতে রুমে ফিরে টিভিতে চোখ বুলিয়ে বেশ কিছু আপডেট খবর জানলাম। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যতবার ভারতে যান, কিংবা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কেউ বাংলাদেশ সফর করলে তিস্তা ইস্যুটি নতুন করে আলোচনায় আসে। বাংলার মানুষ আশায় বুক বাঁধে হয়তো এবার একটা সুখবর আসবে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে। এবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। দুই বাংলার গণমাধ্যমগুলোও এনিয়ে বহু কালিব্যয় করেছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সব প্রত্যাশার বেলুন ফুটো করে দিয়ে মমতা বললেন ‘তিস্তা নিয়ে আলাপের জায়গা এটি নয়’।
কোলকাতা টিভির আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়েছে শুক্রবার কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে আসছেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ওইদিনই বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। শান্তিনিকেতনের পাশেই চুরুলিয়া। কবি পরিবারের কয়েকজনের ইন্টারভিউসমেত চ্যানেলটি রিপোর্ট করছে ‘সবাই আশা করেছিলো হাসিনা চুরুলিয়া আসবেন, কিন্তু তিনি এলেন না- আমরা কষ্ট পেলাম’।
তবে বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার যে আলাদা সম্মান করে তার প্রমাণ ছিলো পুরো আয়োজনজুড়ে। অনুষ্ঠানের আগের রাতেও সার্বিক প্রস্তুতি এবং নিরাপত্তা আয়োজন দেখতে একাধিক কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রী আসেন শান্তিনিকেতন ক্যাম্পাসে। শুধু সরকার কেন, ভারতের জনগণও বেশ উচ্ছ্বসিত। রাস্তাঘাটে নিরাপত্তার কড়াকড়ি দেখে বহু ভারতীয়কে বলতে শুনেছি ‘আমাদের বাংলাদেশের দিদি আসছে’।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সিলেট প্রেসক্লাব; সিলেট ব্যুরোপ্রধান, একাত্তর টেলিভিশন।