শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘বাংলাদেশকে কেন রাণী বলা হয় তা উপলব্ধি করেছি’

প্রকাশিতঃ ৯ জানুয়ারী ২০১৯ | ৩:১৮ অপরাহ্ন

ইফতেখার সৈকত : কৌতুহলী মানুষের বৈচিত্রময় জীবন। নতুনত্ব ও অজানাকে জানার ইচ্ছা মানুষের প্রবল। তেমনি একজন কৌতুহলী এবং অদম্য যুবক সাখাওয়াত।

ছেলেবেলা থেকেই সাইকেলের সাথে তার বেশ সখ্যতা এবং দেশ ভ্রমণের প্রবল ইচ্ছা। মানুষকে ভ্যাট সম্পর্কে সচেতন করতে এবং ‘আমার দেশ আমি দেখবো’ এমনই এক ইচ্ছা থেকে সাইকেলিং করে প্রায় ১১৮৫ কি.মি পথ পাড়ি দিয়েছে সাখাওয়াত হোসাইন। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে তাকে টানা ১০ দিন সর্বমোট ৭৫ ঘন্টা সাইকেল চালাতে হয়।

সাখাওয়াত হোসাইন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অর্থনীতি বিভাগের (১৬-১৭) শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। সে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ গ্রামের মাহমুদুল হক শিকদারের সন্তান।

পরিবারকে না জানিয়ে নিজের টিউশনের টাকা এবং পরবর্তীতে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়েই সে এই ভ্রমন সম্পন্ন করে। ভ্রমণের সময় পরিচিত কোন বন্ধু, আত্মীয়, সরকারি বাংলোর বারান্দা বা কোন স্কুলই ছিলো তার ঘুমানোর জায়গা।

১১ ডিসেম্বার সাখাওয়াত চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো.ইলিয়াস হোসাইন থেকে ভ্যাট সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে টেকনাফ থেকে তেতুলীয়া পর্যন্ত সাইকেল ভ্রমণের অনুমতিপত্র নেয়।

তবে যাত্রা শুরু হয় ২০ ডিসেম্বার থেকে। চট্টগ্রাম থেকে প্রথমে বাসে করে পঞ্চগড় যায় সাখাওয়াত। ওখান থেকে ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর-গাইবান্ধা-বগুড়া-সিরাজগঞ্জ-টাঙগাইল-গাজীপুর-ঢাকা-নারায়নগঞ্জ-কুমিল্লা-ফেনী-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা ভ্রমণ করে।

এই জেলাগুলোর আওতায় সাখাওয়াত তেঁতুলিয়া-বোদা-শীবগঞ্জ-বীরগঞ্জ-ফুলবাড়ি-বিরামপুর-গোবিন্দগঞ্জ-শেরপুর-রায়গঞ্জ-মির্জাপুর-কালিয়াকৈর-আশুলিয়া-মিরপুর-নারায়নগঞ্জ-দাউদকান্দি-চান্দিনা-চৌদ্দগ্রাম-ফেনী-মীরসরাই-সীতাকুন্ড-হাটহাজারী-পটিয়া-চন্দনাইশ-সাতকানিয়া-লোহাগড়া-চকরিয়া-কক্সবাজার-উখিয়া-টেকনাফ উপজেলা ভ্রমণ করে।

১০ দিনের ভ্রমণে সাখাওয়াত ১০টি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে। স্থানগুলো হলো-বাংলাবান্ধা (১ম দিন)-কালিবাজার (২য়দিন)-বিরামপুর (৩য় দিন)-শেরপুর (৪র্থ দিন)-কালিয়াকৈর (৫ম দিন)-নয়াপল্টন (৬ষ্ঠ দিন)-ফেনী (৭ম দিন)-হাটহাজারী (৮ম দিন)-কক্সবাজার (৯ম দিন)-টেকনাফ (১০ম দিন)।

তার ভ্রমনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্রগুলো হল, বাংলাবান্ধ জিরো পয়েন্ট (তেতুলীয়া), ময়নামতি, মহাস্থানগড়, বঙ্গবন্ধু সাপারী পার্ক, চকরিয়ার ডুলাহাজরা ও চুনতী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কক্সবাজার, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানি বিচ এবং সর্বশেষ সেন্টমার্টিন দ্বীপ।

সাখাওয়াতের সাইকেলে ভ্রমণের কারণ এবং অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে একুশে পত্রিকাকে বলেন, প্রত্যেকটা নাগরিকের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে কর প্রদান করা। কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ জনগণ ভ্যাট বা কর কি তা জানেই না। তাদেরকে ভ্যাটের বিষয়ে সচেতন করতে এবং নিজ দেশকে নিজ চোখে দেখার তাড়না থেকেই আমি সাইকেলে করে ভ্রমণ করেছি।

এধরনের কাজের জন্য সাইকেল কেন ব্যাবহার করলো? এমন প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত বলেন, আমার কাছে সাইকেলের চেয়ে উত্তম যানবাহন আর কিছু মনে হয় না। এটি পরিবেশবান্ধব এবং সাশ্রয়ী। তাছাড়া সাইকেলকে আমি খুব পছন্দ করি।

১০ দিনের সাইকেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে সাখাওয়াত বলেন, বাংলাদেশ যে অনেক সুন্দর দেশ তা বইয়ের পাতায় পড়েছি। তবে তা উপলব্ধি করতে পারি নি। আজকে আমি উপলব্ধি করতে পারি কতটা সুন্দর এই বাংলাদেশ। কেন এই দেশকে রাণী বলা হয়। এদেশের নদী, মাঠ, ঘাট দেখে যে কারোরই চোখ জুড়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন, এ দেশটা যেমন সুন্দর তেমনটা বৈচিত্রময়। এ দেশের এক অঞ্চলের মানুষ এক এক ধরণের। তাদের ভাষা, চালচলন, সংষ্কৃতি, পেশা এবং ধর্মে রয়েছে ভিন্নতা।

প্রসঙ্গক্রমে সাখাওয়াত বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য। তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য বিষয়ক স্মৃতি স্তম্বগুলো বেশি স্থান পেয়েছে।

সাখাওয়াত- নির্যাতন ৭১, যুদ্ধ জয়, দিনাজপুর তোরণ, তেভাগা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু, কৃষক আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, শাপলা চত্বর, দোয়েল চত্বর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলাসহ বেশ কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ব ভ্রমণ করেন।

উত্তরাঞ্চলের লোকদের কৃষির দক্ষতার প্রশংসা করে তিনি বলেন, উক্তরাঞ্চলের কৃষকরা খুবই নিবিড় পরিচর্যায় কৃষিকাজ করে থাকেন। উত্তরাঞ্চলের যানবাহন হিসেবে টমটম ও ভ্যানগাড়িকে চিহ্নিত করে সাখাওয়াত। এই অঞ্চল সম্পর্কে সাখাওয়াত আরো বলেন, এখানকার স্কুলগুলো দূরে হওয়ায় মেয়েরা দল বেঁধে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। যা প্রসংশার দাবিদার।

এদিকে সাখাওয়াতের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে দক্ষিণাঞ্চল সম্পর্কে বলেন, এখানে শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যের অবস্থান খুবই মজবুত। তবে দক্ষিণাঞ্চলে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের চিহ্ন বেশি পাওয়া যায় না। দক্ষিণাঞ্চলে মাজারের সংখ্যাই নাকি বেশি।

পর্যটনকেন্দ্র গুলোর মধ্যে পছন্দের তালিকায় সেন্টমার্টিনকে শীর্ষে রেখে সাখাওয়াত বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ আমাকে খুব বিমোহিত করেছে। সেখানকার নীল পানি, শীতের অথিতি পাখি, সমুদ্র উপকূলের নারিকেল গাছ এবং বীচে ঘুরে বেড়ানো কুকুরগুলো সত্যিই চমৎকার। তাছাড়া তেতুলীয়ায় অবস্থিত বাংলাবান্ধ জিরো পয়েন্টের (যেখান থেকে বাংলাদেশের সীমানা শুরু হয়েছে) মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপন, মহাস্তানগড়ের জিয়ৎ কূপ (বিশেষত্ব-প্রথা অনুযায়ি তৎকালীন রাজারা তাদের মৃত সৈনিককে কুণ্ডে নিক্ষেপ করলে তারা জীবিত হয়ে যেত), বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসর ঘর, ময়নামতির শালবন বিহার, বৌদ্ধবিহার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, রমনাপার্ক, শাহাবাগ, কক্সবাজারের সূর্যাস্ত, মেরিন ড্রাইভ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহুত্বগুলো আমাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে।

এতটুকু পথ অতিক্রম করে সাখাওয়াতের অভিযোগ হাইওয়ে রোডে গাড়িগুলো চলছে খুবই বেপরোয়া ভাবে। যার জন্য সড়ক দূর্ঘটনাসহ যত্রতত্র কুকুর মারা যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকাই নাকি ছিলো তার দীর্ঘ পথে একমাত্র অসহনীয় জায়গা। যেমন ওই শহরের রাস্তাগুলো, তেমনি জানজট। আবার ময়লা-আবর্জনা তো রয়েছেই।

ভোটের সময়ে এমন উত্তেজনা কর পরিস্থিতিতে লাল সবুজের পতাকায় মোড়ানো সাখাওয়াতকে কেউ বাধা দেয় নি। বরং বিভিন্ন জায়গার মানুষজন তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। সাখাওয়াত বলেন, এক পুলিশ সদস্য তার পথ আটকালেও ছাড়পত্র দেখে কোনরকম হেনস্থ ছাড়াই যেতে দেয়।

এদিকে ২৩ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ১০ মাইল এলাকায় শেখ হাসিনার আগমনে যখন কড়া নিরাপত্তা চলছিলো তখনও তাকে কেউ বাধা দেয় নি। তার সাইকেলে জড়ানো লাল সবুজে পতাকা আর জেলাপ্রশাসকের ছাড়াপত্র দেখে সবাই তাকে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করেছে বলেও জানায় সাখাওয়াত।

সাইক্লিং নিয়ে সাখাওয়াতের চিন্তা সুদূরপ্রসারী। তার ইচ্ছা মানুষ সাইক্লিং এর প্রতি আকৃষ্ঠ হোক। তার স্বপ্ন সাইকেল চালিয়ে একদিন সে পুরো বাংলাদেশ ঘুরে দেখবে। বর্তমানে সে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি), চবি শাখার একজন ক্যাডেট এবং এ্যাডবেঞ্চার ক্লাব অব চট্টগ্রামের একজন সদস্য।

একুশে/আইএস/এসসি