বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে চট্টগ্রাম, ৭০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২৯ মার্চ ২০২৫ | ১১:৩৭ অপরাহ্ন


দেশের অন্যতম প্রধান বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, সম্প্রতি মিয়ানমারে আঘাত হানা ৭.৭ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প চট্টগ্রামে আঘাত হানলে নগরের প্রায় ৭০ শতাংশ ভবনই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তথ্যমতে, নগরের ৩ লাখ ৮২ হাজারেরও বেশি ভবনের মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৬৭ হাজার ভবন এই ঝুঁকির আওতায় রয়েছে। ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড ও নিয়ম-নীতির ব্যাপক লঙ্ঘন, নকশা বহির্ভূত নির্মাণ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রস্তুতির অভাব এই আশঙ্কার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত শুক্রবার মিয়ানমারে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর চট্টগ্রামে ঝুঁকির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস উভয়েই একমত যে, ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে চট্টগ্রামের প্রায় ৭০ শতাংশ ভবনই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সিডিএ’র হিসাবে, নগরে বর্তমানে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১১টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগই (২ লাখ ৭৮ হাজার ৫টি) একতলা। এছাড়া ২ থেকে ৫ তলা ভবন ৯০ হাজার ৪৪৪টি, ৬ থেকে ১০ তলা ১৩ হাজার ১৩৫টি এবং ১০ তলার ঊর্ধ্বে ৫২৭টি ভবন রয়েছে। ২০ তলার বেশি উঁচু ভবন আছে ১০টি।

২০০৯ থেকে ২০১১ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) আওতায় পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, তৎকালীন ১ লাখ ৮২ হাজার ভবনের মধ্যে ৯২ শতাংশই (১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫০টি) ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে ছিল, কারণ সেগুলো বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে নির্মিত হয়নি। জরিপটি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

চুয়েটের সাবেক উপাচার্য ও সিডিএমপি জরিপে চট্টগ্রাম অংশের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “চট্টগ্রাম ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে। ৭০ ভাগ ভবনই ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ এগুলো ইমারত বিধিমালা বা জাতীয় বিল্ডিং কোড মেনে হয়নি। ভবনগুলোতে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেই। সিডিএও তদারকি করেনি।” তিনি অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে সেগুলোর শক্তি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

বিপর্যয় মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েও তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অধ্যাপক আলম বলেন, “এককথায় ভূমিকম্প–পরবর্তী অবস্থা মোকাবিলা করতে আমরা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, সিডিএ—কারও কোনো বিশেষ প্রস্তুতি নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, অনেক ঘিঞ্জি এলাকায় উদ্ধারকারী গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স ঢোকারও সুযোগ নেই।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ভূমিকম্প–বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ায় এখন থেকেই স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জনগণকে সচেতন করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নিয়মিত মহড়া আয়োজনের ওপর জোর দেন তিনি।

চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী ভবন নির্মাণের ৮টি স্তরে অনুমোদন নেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিকেরা প্রাথমিক নকশা অনুমোদনের পর বাকি ধাপগুলো অনুসরণ করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ভবন নির্মাণে সিডিএর তদারকিতে ঘাটতি ছিল এবং এমন জায়গায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যেখানে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন।

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস লোকবল সংকটের কারণে তদারকিতে ঘাটতির কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি দাবি করেন, বর্তমানে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে এবং ১০ তলার ওপরের ভবনগুলো বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করা হচ্ছে।

যদিও সাম্প্রতিককালে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তবে ২০১৬ সালে ৬.৯৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ১২টি ভবন হেলে পড়েছিল এবং ১৯৯৭ সালে ৬.১ মাত্রার ভূমিকম্পে ভবন ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশেরও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাওয়ার ঘটনা চট্টগ্রামের জন্য এক অশনি সংকেত। যথাযথ পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি গ্রহণ না করা হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদহানির ঝুঁকি অত্যন্ত প্রকট।