কক্সবাজার শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঁকখালী নদীর দখল ও দূষণের ভয়াবহ চিত্র দেখে তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বৃহস্পতিবার সরেজমিনে নদীটির বেহাল দশা প্রত্যক্ষ করেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুই উপদেষ্টা নদীর কস্তুরাঘাট পয়েন্টে যান। সেখানে সংরক্ষিত প্যারাবন ধ্বংস করে গড়ে তোলা সারি সারি অবৈধ বসতবাড়ি, দোকানপাট, পোলট্রি ফার্ম, চিংড়ি ঘের এবং প্লট আকারে বিক্রি হওয়া নদীর জায়গা দেখেন তারা। এসময় তাদের সাথে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন, পুলিশ সুপার মো. সাইফুদ্দিন শাহিন, পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মো. জমির উদ্দিনসহ বিআইডব্লিউটিএ, বন বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কস্তুরাঘাট থেকে উপদেষ্টা দলটি নদীর পেশকারপাড়া অংশে যান, যেখানেও দখল ও দূষণের একই রকম উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে ওঠে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তারা।
উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “নদীর অর্ধেকেরও বেশি জায়গা দখল হয়ে গেছে। শত শত অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। নদীর জায়গা নদীকে ফেরত দিতে হবে। নৌবন্দরের জায়গাও থাকতে হবে।” অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ারও ইঙ্গিত দেন তিনি।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “দখল আর দূষণে বাঁকখালী নদী এখন মৃতপ্রায়। অবৈধ স্থাপনা ক্রমাগত বাড়ছে। অনেকে আবার আদালতের নিষেধাজ্ঞার সুযোগ নিচ্ছেন। তবে নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে। নদীটিকে বাঁচাতে যা যা করণীয়, সবকিছুই করা হবে।”
দখলের মহোৎসব, উচ্ছেদ হয় আবার ফিরে আসে
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, শুধু গত এক বছরেই কস্তুরাঘাট এলাকায় প্রায় ৩০০ একর প্যারাবনের লাখো গাছ কেটে চার শতাধিক পাকা ও আধাপাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় দুই যুগ আগে জাপানের একটি সংস্থা এই প্যারাবনটি সৃজন করেছিল। এছাড়া পেশকারপাড়া, মাঝিরঘাট, ৬ নম্বর জেটিঘাট, ফিশারীঘাট ও নুনিয়াছটা পর্যন্ত নদীর আরও কয়েক কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে ছয় শতাধিক অবৈধ স্থাপনা।
সরকারি হিসাবও প্রায় একই রকম। বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, গত এক বছরে নদীর প্রায় ৬ কিলোমিটার অংশে ৬০০ একরের বেশি প্যারাবন ধ্বংস করে প্রায় ১ হাজার ২০০ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে শুধু জীববৈচিত্র্য বা মৎস্য সম্পদই ধ্বংস হয়নি, উচ্ছেদ হয়েছে পাখির আবাসস্থলও। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় অন্তত পাঁচটি চক্র প্যারাবনের জায়গা প্লট আকারে বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
প্রায় আড়াই বছর আগে নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই মূলত ভূমিদস্যুদের নজর পড়ে নদীর দুই তীরের প্যারাবনের দিকে। একসময়ের দেড় মাইল প্রশস্ত নদীটি সেতুর কাছে এখন মাত্র ২০০ ফুটে সংকুচিত হয়ে গেছে, যা নৌ চলাচলেও বাধার সৃষ্টি করছে।
যদিও ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে ও মার্চের শুরুতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে কস্তুরাঘাটের চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রায় ৩০০ একর জমি দখলমুক্ত করেছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই দখলদাররা আবার ফিরে এসে স্থাপনা নির্মাণ করে, অনেকে টিনের বেড়া দিয়ে বিশাল এলাকা ঘিরেও রেখেছে। গত বছরের মে মাসে জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিএস দাগ অনুযায়ী উচ্ছেদ ও সীমানা নির্ধারণের নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
দূষণে জর্জরিত বাঁকখালী
দখলের পাশাপাশি ভয়াবহ দূষণের শিকার বাঁকখালী। কক্সবাজার শহরে প্রতিদিন উৎপাদিত ৯৭ টনের বেশি বর্জ্যের মধ্যে প্রায় ৭০ টনই ফেলা হচ্ছে এই নদীতে, বাকিটা চলে যাচ্ছে সাগরে। বছরের পর বছর ধরে বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর বিভিন্ন অংশে রীতিমতো ‘ময়লার পাহাড়’ জমেছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পৌর কর্তৃপক্ষ এখনও নদীতে বর্জ্য ফেলা অব্যাহত রেখেছে, কারণ শহরে নির্দিষ্ট কোনো ডাম্পিং স্টেশন নেই। দুই উপদেষ্টা নদীর বুকে জমে থাকা এসব বর্জ্যের স্তূপও প্রত্যক্ষ করেন।
বিকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে দুই উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বৈঠক থেকেই বাঁকখালী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে।