বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

১৮ খাতের মজুরি হালনাগাদ নেই দশকের পর দশক, মূল্যস্ফীতিতে পিষ্ট শ্রমিক জীবন

সর্বনিম্ন মজুরি ৩৭০০, সর্বোচ্চ ১৮০০০: খাতভেদে ব্যাপক বৈষম্য, সংস্কারের সুপারিশ
একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১ মে ২০২৫ | ৭:৫৮ পূর্বাহ্ন


দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হলেও সরকারের নির্ধারিত ৪৩টি খাতের মধ্যে ১৮টিরই ন্যূনতম মজুরি কাঠামো হালনাগাদ করা হয়নি বহু বছর ধরে। কোনো কোনো খাতের মজুরি কাঠামো প্রায় চার দশক আগের।

আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর মজুরি কাঠামো হালনাগাদ করার কথা। এছাড়া সিরামিক, পোলট্রি, ব্যাটারি প্রস্তুতকারক এবং রঙ ও কেমিক্যাল কারখানার মতো নতুন খাত অন্তর্ভুক্ত হলেও সেগুলোর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এখনও নির্ধারণই করা হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে মে দিবসে শ্রমিকদের অধিকার ও জীবনমান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নতুন করে। সর্বশেষ মার্চ মাসেও দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে আয় না বাড়ায় বহু শ্রমজীবী পরিবারকে অবর্ণনীয় কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পেট্রল পাম্প খাতে সর্বশেষ মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৮ বছর আগে, ১৯৮৭ সালে। টাইপ ফাউন্ড্রির মজুরি কাঠামো তারও আগে, ১৯৮৩ সালের। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো ২০১২ সালের। এছাড়া হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যালস ও টি প্যাকিং খাতের মজুরি কাঠামো হালনাগাদ করা হয়েছিল ২০১৭ সালে। জাহাজ ভাঙা, বেকারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ এবং অ্যালুমিনিয়াম খাতের মজুরি কাঠামো শেষবার হালনাগাদ হয় ২০১৮ সালে।

একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, তার এবং তার মায়ের আয়েও এখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

একটি গার্মেন্টসে কর্মরত হামিদা জানান, নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ওভারটাইম এবং বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেও তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। কারণ প্রতি বছর জিনিসপত্রের দাম ও বাড়িভাড়া বাড়লেও আয় বাড়ছে না।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার বলেন, “বাংলাদেশের সব খাতের শ্রমিকের মজুরি কাঠামো জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানোর জন্য খুবই কম। আমরা মজুরি বাড়ানো এবং জাতীয় মজুরি কাঠামো প্রণয়নের জন্য বারবার দাবি জানিয়ে এসেছি। বাজারমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মজুরি সমন্বয় করার কথাও বলেছি।”

বর্তমানে বেসরকারি খাতে মাসভিত্তিক কাঠামোতে সবচেয়ে বেশি মজুরি পান স’ মিলের শ্রমিকরা (১৭,৯০০ টাকা)। এরপর রয়েছে নির্মাণ ও কাঠ শ্রমিক (১৬,২৪০ টাকা), জাহাজ ভাঙা শ্রমিক (১৬,০০০ টাকা)। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা।

অন্যদিকে, সবচেয়ে কম মজুরি পান হোটেল ও রেস্টুরেন্ট খাতের শ্রমিকরা, মাসিক মাত্র ৩,৭১০ টাকা। ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৪,৫৬০ টাকা এবং জুট প্রেস খাতের শ্রমিকদের ৪,৮৫০ টাকা।

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) ভাইস প্রেসিডেন্ট তাহমিদ আহমেদ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মজুরি সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও সব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার প্রশ্নটি সামনে এনেছেন। তিনি বলেন, “ছোট একটা কারখানার যদি ১০ শতাংশ মজুরি বাড়াতে যায় তাহলে সে চলতেই পারবে না। তবে ভিন্ন সেক্টরে আলাদাভাবে মজুরি বাড়ানো যেতে পারে।”

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন মজুরি প্রতি তিন বছর পর পর পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, তারা জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ (লিভিং ওয়েজের ভিত্তিতে), বার্ষিক মজুরি পুনর্মূল্যায়ন এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করেছেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, “আমরাও একটা পরিবর্তন চাচ্ছি। তবে এটার জন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। তার ভিত্তিতেই বিষয়টা নির্ধারণ করা হবে।”