বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

ফার্মেসিতে ৪০% ওষুধই ভেজাল, হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১৪ জুলাই ২০২৫ | ১০:৪৫ পূর্বাহ্ন


দেশব্যাপী জীবন রক্ষাকারী নকল ও ভেজাল ওষুধের যে ‘নীরব মহামারি’ ছড়িয়ে পড়েছে, তার ভয়াল থাবা পড়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামেও। রাজধানীর মতোই চট্টগ্রামের ওষুধের বাজারেও প্রায় ৪০ শতাংশ ওষুধই নকল বা ভেজাল বলে আশঙ্কা করছেন বিক্রেতারা। নগরীর নামীদামী ফার্মেসি থেকে শুরু করে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ওষুধের দোকান পর্যন্ত সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে এই বিষাক্ত জাল। বিশেষ করে ইনসুলিনের মতো সংবেদনশীল ওষুধও নকল হচ্ছে, যা রোগীদের জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে।

চট্টগ্রামের একাধিক ওষুধের দোকানের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশি আমদানিকৃত ইনজেকশন ও দামী ওষুধের নকলই বেশি পাওয়া যায়। অসাধু চক্র হুবহু একই রকম মোড়ক ও রং ব্যবহার করে এসব নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে। এই চক্র এতটাই শক্তিশালী যে, অনেক বিক্রেতা না বুঝেই এসব ওষুধ বিক্রি করছেন।

আবার কেউ কেউ কম দামে কিনে বেশি লাভে বিক্রির লোভে এই অনৈতিক বাণিজ্যে জড়াচ্ছেন। বিশেষ করে জেলার প্রত্যন্ত উপজেলা, যেমন—বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড বা ফটিকছড়ির গ্রামগুলোতে ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। সেখানে তদারকি কম থাকায় নিম্নমানের কোম্পানিগুলোর নকল ও ভেজাল ওষুধ কম দামে সহজেই বিক্রি হচ্ছে।

নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যর্থতা

ওষুধের এই ভয়ংকর নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন প্রায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিক্রেতাদের দাবি, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা চট্টগ্রামে চোখে পড়ে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা জানান, “নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারী ও বিক্রেতাদের কাছ থেকে একশ্রেণির কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোয়ারা পান, তাই তারা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।”

যদিও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দেশব্যাপী অভিযান অব্যাহত রাখার কথা বলছে, কিন্তু তাদের জনবলের ঘাটতির বিষয়টিও স্বীকার করেছে। অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফ হোসেন জানান, সীমিত জনবল দিয়ে ওষুধের বিশাল বাজার তদারকি করা এবং নকল-ভেজাল রোধ করা অত্যন্ত কঠিন।

বিশেষজ্ঞদের চোখে এ এক ‘গণহত্যা’

নকল ও ভেজাল ওষুধের ভয়াবহতা নিয়ে চট্টগ্রামের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, বেশির ভাগ কোম্পানির ওষুধ তৈরির কাঁচামালই নিম্নমানের, তার ওপর আবার নকল করা হলে তা বিষে পরিণত হয়।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, “নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবনে রোগীর দেহে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, এমনকি অঙ্গহানিরও সম্ভাবনা রয়েছে।”

কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ সতর্ক করে বলেন, “যে রোগের জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, নকল ওষুধের কারণে সেই রোগ তো সারবেই না, উল্টো কিডনি বা লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে।”

শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ মোয়াজ বলেন, “শিশুদের ক্ষেত্রে নকল ওষুধ জীবন রক্ষার বদলে জীবন কেড়ে নিতে পারে। এই নকল ওষুধের উৎপাদক বা আমদানিকারকদের শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে।”

গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুসাররাত সুলতানা সুমি জানান, গর্ভবতী মায়েদের জন্য নকল ওষুধ মা ও শিশু উভয়ের জন্যই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

সমাধান কোন পথে?

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের মতে, “ভেজালবিরোধী অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে। পাশাপাশি কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করলে কেউ জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে জালিয়াতি করার সাহস পাবে না।”

ঔষধ শিল্প সমিতি বলছে, দেশের ২২৯টি কোম্পানি মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করছে এবং অর্ধশতাধিক কোম্পানি বিদেশে রপ্তানি করে সুনাম অর্জন করছে। কিন্তু কিছু অসাধু চক্রের কারণে পুরো শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে।

দেশের স্বাস্থ্যখাতকে এক নীরব মহাদুর্যোগ থেকে বাঁচাতে হলে এখনই চট্টগ্রামে ও দেশজুড়ে একযোগে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা এবং নকল ওষুধের উৎপাদক, বিক্রেতা ও তাদের মদদদাতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।