শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বইশখালা উপাখ্যান

প্রকাশিতঃ ২৯ জুন ২০২০ | ৩:১০ অপরাহ্ন


ফয়সুল আলম : ইদানিং ঘুম আর জাগরণে কিসের মধ্যে যেন ঢুকে পড়েছি রাতদিন বুঝে উঠতে পারছিনা। বেশ কিছুদিন ধরে কিছু একটা লিখব ভাবছি। কিন্তু কী নিয়ে লিখব? ভাবনাটা ঠিক মাথায় আসছে না। আবার আসলেও একসাথে এতগুলো ভাবনা চলে আসে যে মাথায় তখন দাঁড় কাকের বিশ্রী রকম সুন্দর ডাকের মত কেছ কেছ করে ভাবনাগুলো। ফলে কোন দিকেই মন স্থির করতে না পারার দরুণ বদহজম হয়। ভালো ঘুম হয়না। বর্ষা চলে এলো। বর্ষার সাথে খাল-বিলের খুব চমৎকার একটা সখ্যতা রয়েছে। খাল নিয়ে একটা গল্প করা যাক।

বৈশাখের শেষের দিকে মেঘনা থেকে নতুন পানি ঢুকতে শুরু করেছে খালে। যৌবনবতী হয়ে উঠছে খালটি। আশপাশের গ্রামগুলোতেও নতুন জলের কলকলানি। গল্পের এই খালের নাম বইশখালা। জনশ্রুতি আছে খালের উজানের মেঠোপথ ধরে চলত মহিষের গাড়ি। দিনশেষে শত শত মহিষ খালের পানিতে গড়াগড়ি দিয়ে আয়েশ করত। আঞ্চলিক ভাষায় এই অঞ্চলে মহিষকে ‘বইশ’ বলে ডাকে। সেই থেকেই খালের নামকরণ বইশখালা হয়েছে। কেউ কেউ আবার একে মহিশখালাও বলে।

ভৈরবের আগানগর ইউনিয়নের শ্যামপুর আর উমানাথপুর গ্রামের বুক ছিড়ে মেঘনার পানে বয়ে যাওয়া এই খালটার আছে স্বতন্ত্র এক ইতিহাস যা লোক মুখে শোনা যায়। যদিও এখন খালটি মৃতপ্রায়। দেখলে মনে হয় যেন ধানি জমির মাঠ। অনেকটা পাশের উখদিপুর বোরো ধানি জমির মাঠের মতই। একসময় নাকি লঞ্চ, স্টিমার পর্যন্ত চলত এই খাল দিয়ে। খালের উজানে বিশাল এক বটবৃক্ষের নিচে গড়ে উঠেছিল এক হাট। হাটের নাম ‘রববাইরা বাজার’। সপ্তাহের রবিবারেই কেবল হাট বসতো বলে এরকম নামকরণ। কালের বিবর্তনে বটগাছটির অস্তিত্ব যেমন বিলীন হয়েছে তেমনি বরবাইরা বাজারও আর বসেনা এখানে। বর্ষা ছাড়া খালটি এখন প্রায় পানিশুন্য। সে বেশি দিন আগের কথা না। খালের নতুন পানিতে কচি কচি হেলেঞ্চা,ধল, বিষকড়ালি,নল আর হোগলা ঘাস হাবুডুবু খাচ্ছে। কাটা ধানের গোড়া তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। ক্রমেই বাড়ছে পানি। স্বচ্ছ টলমলে পানিতে হালকা ঢেউয়ের কাঁপন জাগে। রাত গড়িয়ে ভোরের আলো ফুটতেই পানি বেড়ে যায় হাঁটু সমান।

বোরো ধান উঠে যাওয়ার পর বইশখালার পাশের খাঁ-খাঁ করা চরটার চারদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সতেজ হয়ে উঠেছে চরের ঘাস, লতা-গুল্ম, শাপলা, শালুক। কিছুদিন পরেই চরে নৌকা নামবে। লগিতে নৌকা আটকে মাছ ধরার উৎসব শুরু হবে। কেমন একটা বর্ষা বর্ষা ভাব এসে গেছে বইশখালা আর চরজুড়ে। সন্ধ্যার পরে যখন প্রদীপের আলো জ্বলে ওঠে; তখন চারদিকে জলে ঘেরা শ্যামপুরটাকে মনপুরা দ্বীপ বলে মনে হয়। ভরা বর্ষায় থৈ থৈ পানির মধ্যে বইশখালার উজানে এক চিলতে আশা নিয়ে জেগে আছে গ্রামটি।

পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার জোগাড়-যন্তর চলতে থাকে গ্রামজুড়ে। এখানে বৈদ্যুতিক আলো নেই। বর্ষা এলে পায়ে হাটার যোগাযোগের রাস্তা-ঘাট থাকেনা;নৌকাই মানুষের একমাত্র ভরসা। বৈশাখের এই শেষ সময়টায় চলতে থাকে বর্ষা যাপনের প্রস্তুতি। ক্ষরা মৌসুমে খসখসে ভূমি থেকে যে ফসল মেলে,তা জিইয়ে রেখেই চলে কৃষকের আগামীর সংসার। বর্ষা এলে হয় পেশার বদল। কৃষিকাজ ফেলে শুরু হয় মাছ ধরা।

মেঘনার অববাহিকায় সৃষ্ট বইশখালা খালে মাছও আসে প্রচুর। বোয়াল,চিতল, রুই, কাতল থেকে শুরু করে মলা, ঢেলা, শিং, মাগুর, বেলে, কালিবাওস, চিংড়ি, পুটি, টাকিসহ নানান কিসিমের ছোট বড় মাছ আসে জেলেদের জালে। বর্ষার এই সময়টায় শ্যামপুরের প্রায় সবাই তখন মাছ ধরে। আশপাশের এলাকাবাসি বা ব্যবসায়ীরা হন সেই মাছের খরিদ্দার। সারারাত মাছ ধরে সকালে ছাগাইয়ার কাছারিঘাটে নৌকা বেঁধে রেখে কিছুটা পথ পায়ে হাঁটলেই গকুলনগর বাজার। রাস্তার দুপাশে বসে অস্থায়ী মাছের হাট। শ্যামপুরের এই অস্থায়ী জেলেদের ধরা মাছেই উদরপূর্তি হয় আশপাশের এলাকার গেরস্থের।

পানিও বাড়ে, মাছও বাড়ে। বাড়ে জেলের সংখ্যাও। রাতের বইশখালা আর শ্যামপুর চরটি আলোকিত হয়ে যায় প্রদীপের আলো পেয়ে। হ্যাজাক, হারিকেন বা কেরোসিনের বাতি জ্বলে প্রতিটি নৌকায়। যারা নিরাক চায়; তাদের হাতে থাকে ৩ ব্যাটারির টর্চলাইট। এতো এতো নৌকা থাকার পরেও পুরো এলাকা জুড়ে সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে ঝুপঝাপ শব্দ ছাড়া মানুষের কণ্ঠ তেমন মেলে না। বর্ষা এলেই যেন যৌবন ফিরে পায় বইশখালা এবং উজানের চরটি। জোছনার আলোতে চিক চিক করা বালিতে বেলে মাছের শুয়ে শুয়ে আয়েশ করার দৃশ্যটা কেবল এই চরেই মিলে।

নতুন পানির আগমনে মেঘনার তীরবর্তী গ্রামজুড়ে ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে। ধারনা করা হয় শ্যামপুরের বাসিন্দাদের ভেঙে যাওয়া ঘর-বাড়িই চর হয়ে ফিরে এসেছে। তবে চরের অধিকাংশ জমির দখল ছাগাইয়া গ্রামের গেরস্থেদের। বর্ষা এলে এই চর আর কারো দখলে থাকে না। চলে যায় জেলেদের অধীনে। বাড়তি পানিতে তখন মাছ ধরার আয়োজন চলতে থাকে। শ্যামপুরের যুবকরা চরের বুকে নৌকা ভাসিয়ে সারারাত মাছ ধরে। কেউবা কারেন্ট জাল পেতে বসে থাকে। চাই, লাড় বা বররা পাতে কেউ কেউ। সুতার মধ্যে দেড় হাত পর পর বড়শি টানিয়ে তাতে কেঁচো গেঁথে ছোট্র কোষা নৌকায় মাছ ধরে জয়নাল,মোবারক, শাহ আলী, বাচ্চু সহ অনেকেই। এই পদ্ধতিকে তারা বলে ‘লাড়’,‘বররা’। জয়নালের বয়স বেড়ে গেছে। এখন তার ছেলে বাদল বররা পাতে।

ঘরে বসে ফিরফিরি করে বুড়ো জয়নাল,‘আরে ওই বাদইল্লা,বইশের মত শইল টা লইয়া ঘরে বইয়া থাকলে চলবঅ? বাইরামাস আয়া পড়ছে। কোষাডা এবার ঠিক করা লাগবত।’ কাশির ধমকে আর বলতে পারে না জয়নাল। ‘সারাদিন কাশঅ তবু হুক্কা খাওনডা ছাড়না’-বাপকে বলে বাদল। বাবার ক্লান্তি লক্ষ্য করে বাদল বলে,‘নাউ এর তলায় ছোড ছোড বিন্দুর হইছে। তক্তাও ত পইচা গেছে কিছু। ছাগাইয়ার কাঠমিসতুরি জিনিস্যারে ডাইকা নৌকাডা মেরামত করা দরহার।’ গলায় আটকে থাকা একদলা শক্ত কফ মাটিতে ফেলে জয়নাল বলে,‘যা করার তুই কর’। অহনো আমার দিকে চাইয়া থাকলে খাইবে কি হালার পুত।’ কিছু বলেনা বাদল। একটু চুপ থেকে হি হি করে হেসে হেসে বলে আব্বা যে কি কয়। আমি হালার পুত হইলে হালাডা কেডা শুনি? শুনতে বকা মনে হলেও বাপ বেটার মাঝে এটা একটা খুনসুটি মাত্র।

বাপের তোড়জোরে এবার নৌকার মেরামতের কাজ শুরু করেতে হবে বাদলকেই। নৌকা বলতে দুই তক্তার ওই ছোট্র একটা কোষা। বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলে নানা জাতের নৌকা চোখে পড়ে। যার মধ্যে কোষা, ডিঙ্গি, পালতোলা বড় আর ইঞ্জিন চালিত নৌকা। কোষা নৌকা মোটামুটি বেশ ছোট সাইজের। খুবই পাতলা কিসিমের। দু-তিন জন উঠলেই নড়েচড়ে। ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে। ডিঙ্গি কোষার চেয়ে আকারে বেশখানি বড়। বেশ লম্বা আর চোখা টাইপের। বেশ মজবুত হয় এই নৌকা। সবাই যার যার সামর্থ অনুযায়ী নৌকা গড়ে। ভৈরব বাজারে গিয়ে তারকাটা, কাঠ, পাতাম, আলকাতরা এসব কিনে আনে বাদল। সময়মতো চলে আসে কাঠমিস্ত্রিরা।

এলাকার কাঠমিস্ত্রিরা বেশিরভাগ হিন্দু। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরও যারা এ দেশ ছেড়ে চলে যায়নি; তাদের বেশিরভাগ এখন কাঠমিস্ত্রির কাজ করে। গেরস্থের ঘর-দুয়ার, নৌকা, দোকান-পাট মেরামত করেই চলে তাদের সংসার। তাদের মধ্যে সুবোধ,জিনিস্যা ও জীবন মিস্ত্রির খুব নাম-ডাক। মুসলমানদের মধ্যেও কাঠমিস্ত্রি আছে। তারা মূলত ঘর গেরস্ত আর আসবাবপত্রের কাজ বেশি করে। নৌকার কাজে এদের তেমন দেখা যায়না। তাদের মধ্যে ওসমান মিস্ত্রী ও নিদু মিয়া বেশ খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছে। এই মৌসুমটাতে মিস্ত্রিদের কদরও বাড়তে থাকে। গ্রামের বেশিরভাগ নৌকাই মেরামত করা হয়ে গেছে। আলকাতরা শুকালেই জলে ভাসানো হবে। বইশখালার উজানে যেটুকু জায়গা এখনও জেগে আছে সেখানটায় জেলেরা বাঁশ টানিয়ে তাতে বেড় জালে কাঁচা গাবের রস মেখে শুকাতে দেয়। বেড় জালে কাঁচা গাব ফলের রস নাকি জালকে মজবুত করে আর তাতে মাছও বেশি ধরা পড়ে বলে জেলেদের বিশ্বাস। মাছ ধরার অন্যান্য যন্ত্রপাতিও প্রস্তুত।

আষাঢ় মাসের শুরু। মৌসুমি বায়ুর আগমনে জ্যৈষ্ঠের গুমোট গরমের ভাবটা কেটে গিয়ে প্রশান্তির একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আষাঢ়ের বৃষ্টি দিনভর বিরতিহীন চলছে। আষাঢ়ের এই অঝোর বর্ষণ বইশখালা ও তার আশপাশের গোটা এলাকার পরিবেশটাকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। বর্ষার সুশীতল বর্ষণ প্রকৃতির সকল চাওয়া পাওয়াকে যেন তৃপ্ত করে চলেছে। চরের শুকনো ফাটা ফাটা ফসলের খেত পরিপূর্ণ হয় পানিতে। বইশখালা ও উজানের চর সব তলিয়ে কানায় কানায় পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। খালের উজানের হিজল গাছটার অর্ধেক পানিতে ডুবে যায়। ক্রমাগত বৃষ্টি আর প্রমত্ত মেঘনার স্রোতধারা বইশখালাকে ভিন্ন একটি আমেজ এনে দেয়। দিনের বেলায় বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বেড়জাল টানে আইয়ুব, কাশেম, হারুন’রা। এ যেন বইশখালার বুকে বর্ষার এক অফুরন্ত লীলা বৈচিত্র্য।

সারাদিন এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে সন্ধ্যার পর কোষা নিয়ে বররা পাততে বের হয় বাদল। বইশখালার বুকজুড়ে এখানে ওখানে বাতির আলো। জেলেদের মাছ ধরার আলাপ-সালাপ। ‘মাছ পাইছসনিরে আঙ্গুর?’ প্রশ্নটা ছোড়ে কালা মিয়া। ‘উগলা ঘাসটা লড়তে দেকলাম। ছলডা দিয়া গাইও মারছিলাম। বালের মাতা ছুইটা গেল মাছটা।’ একটা বিরক্তি ঝারে আঙ্গুর। হঠাৎ দূরের এক নৌকা থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর। ‘হালার বাদইল্লা আর সময় পাইলো না। কষ্টের সময় সুর তুইলা কষ্টটা আরও বাড়ায়া দিলো।’ আঙ্গুরের কথা শুনে হাসে কালা। বাদল আবার কী করলো রে?’ জানতে চায় কালা। ‘ওর বাঁশির সুরে আমি আউলা-ঝাউলা হইয়া যাই।’ বলেই নৌকায় জোরে লগি মারে আঙ্গুর । হ্যাজাক লাইট হাতে চলে যায় কিছুটা দূরে নতুন শিকারের খোঁজে।

ঘরে একলা শুয়ে শুয়ে মনটা কেমন জানি আনচান করে সুন্দরী জয়গুনের। নাম যেমন জয়গুন তেমনি দেখতেও খুব সুন্দরী। চরের মেয়েরা সাধারণত খুব রংচটা হয়। জন্মের পর থেকেই রোদে পুড়ে কালো হয়ে যায়। কিন্তু জয়গুনের বেলায় এই ফর্মুলা খাটেনি। জয়গুন খুবই ফর্সা। চেহারার গড়ন বেশ মানানসই। আকর্ষিত করার মতো দেহ। বাঁশির মত সরু নাকের বামদিকের প্রশস্ত পাতায় মৌসুমি নাকফুল আর নাকের মাঝখানটায় নরম হাড়ে ফুঁড়ানো নাকঠাসা,হস্তিনী পায়ে নূপুর,সরু কোমরে বিছা দুলিয়ে হেঁটে গেলে সব পুরুষের বুকেই কাঁপন তোলে। হৃদয়ের মাঝে আলাদা শিহরণ খেলে যায়। গ্রামের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সুন্দর হয়ে জন্মানোর কারণেই হয়তো সবাই সুন্দরী বলেই ডাকে। খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয় সুন্দরীর। স্বামীর বাড়ি উপজেলা শহর ভৈরবের পঞ্চবটি তে। স্বামী মাতাল প্রকৃতির। বসে বসে গাঁজা খাওয়া আর স্ত্রীকে মারধর করাই তার কাজ। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই সুন্দরীর জীবনে নেমে এলো অসুন্দরের ছায়া। স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে বাপের বাড়িতেই পড়ে আছে সুন্দরী। ইদানিং লোক মুখে শুনা যাচ্ছে সুন্দরীর স্বামী নাকি এরই মধ্যে দিত্বীয় বিয়েটাও করে ফেলেছে।

বাঁশির সুর এসে বিদ্ধ করতে থাকে সুন্দরীর বুক। বাঁশির নৌকাটা তার বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। ইচ্ছে হয়-ছুটে যায় তার কাছে। কিন্তু পারে না। আর গিয়েও বা কি লাভ? ‘আমি ত বিবাহিতা। আমার স্বামী আছে। আবার স্বামী নেই বললেও চলে। না থাকার মতই’। নিঃশব্দে কাদে সুন্দরীর মন। সংকোচে কুকড়ে যায় সুন্দরী। তবুও বুকের মধ্যে যেন মেঘনার উথাল-পাথাল ঢেউ খেলে যায়। কিন্তু কে সেই বাঁশিওয়ালা? ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সুন্দরী।

বাঁশি বাজিয়ে ক্লান্ত হয়ে মাছ ধরা শুরু করে বাদল। মাছ ছাড়া বাড়ি গেলে জয়নাল তাকে ঘরছাড়া করবে। বাপের ভয়ে এবার বররা ফেলে পানিতে। ফেলে বেশিক্ষণ বসতে হয় না। খোট আসে বরশিতে। খোট এলেই বুঝতে পারে বাদল। বররায় নানান মাছ ধরা যায়। একটি লম্বা সুতায় কয়েকশ বড়শিতে কেঁচো গেঁথে গেঁথে একটি মালার মতো বানানো হয়। সেই সুতোর একপ্রান্তে ইট বেঁধে পানিতে ফেলা হয়। সুতার মাথায় একটি কঞ্চি বাঁধা থাকে। সেই কঞ্চিটা থাকে বাদলের হাতে। ঘণ্টা খানেক পর সেই সুতাটা টেনে টেনে নোকায় তুলে বাদল। কেঁচো খেতে আসা মাছগুলা আটকে পড়ে বড়শিতে। এভাবেই ফজর পর্যন্ত মাছ ধরে বাদল। আজান হলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মাঝরাত থেকে ভোর অবধি বেশ ভাল পরিমান ছোট বড় শোল, গজার, বাইম, বেলে, টেংড়া, টাকি, কালিবাইশ আর নলা মাছ নিয়ে ঘরে ফেরে সে।

সকালের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায় সুন্দরীর। ছোটবোন খুকি পরে পরে ঘুমোচ্ছে। রাতের করুণ সুরটা বুকের মধ্যে আলতো খোচা দিয়ে যায়। ‘ইমুন পাগল করা সুরে বাঁশিটা কেডা বাজায়?’ নিজেকেই প্রশ্ন করে সুন্দরী। আবার নিজে নিজেই উত্তর দেয়,‘আমি কি জানি? মন চাইলে খুঁইজ্জা ল গিয়ে?’ নিজেই বলে,‘ছি ছি,তওবা তওবা। আমি খুঁজুম কেড়ে, আমার কি খায়া দায়া আর কোন কাম নাই?’ এবার চুপসে যায় সুন্দরী। সকালের আলো ফুটলেই গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি চড়ে বেড়ায়। ডানপিঠে মেয়ে বলে কথা।

শ্রাবণ মাসের ভর দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে ছাড়াবাড়ির দিকে যায় সুন্দরী। ছাড়াবাড়ি বলতে কতগুলো আম,জাম,তাল, কাঠাল, বাঁশঝাড় আর শিমুল গাছ ভরা বাগান। বসতবাড়ি থেকে একটু দূরে বলেই সবাই ছাড়াবাড়ি বলে। জায়গাটা খুব নির্জন। ঠিক দুপুরে কিংবা সন্ধ্যার পর একা একা কেউ ওদিকে যাওয়ার সাহস করেনা। অনেক রহস্যজনক কাহিনী আছে এই ছাড়াবাড়িটি ঘিরে। এইত কয়েক বছর আগের কথা। রশিদ মিয়ার দশ বছরের মেয়েটা গাছের মরা ডাল-পাতা কুঁড়াতে ঠিক দুপুরে একলা একলা ছাড়াবাড়ি গিয়ে কি যেন একটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেল। কাউকে কিছু বলতে পারেনি। রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। শেষমেশ মেয়েটা ভয় পেয়ে মারাই গেল। এমন আরও অনেকে অনেক অদ্ভুত কিছু দেখেছে নাকি এই ছাড়াবাড়িতে। ছাড়াবাড়ির তালগাছটার কাঁচা তালের দিকে সবার চোখ।

এবার অনেক তাল ফলেছে গাছটায়। তালগাছটার মালিক মিয়া বাড়ির ছোট মিয়া হলেও তাল পাকলে সেটা যেন গ্রামের সবার দখলে চলে যায়। গাছ হতে পাকা তাল হঠাৎ হঠাৎ ধপাস করে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে আগে কুড়াতে পারবে সেই তাল তার-ই হবে। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝিতে তাল পাকে। ভাদ্র মাস আসতে এখনও মাসখানেক দেরি। ছাড়াবাড়িতে বসে গল্প করছে আঙ্গুর, বাদল, কালাসহ কয়েকজন। সুন্দরী হাঁটতে হাঁটতে তাদের হাসি শুনতে পায়।

আঙ্গুর বলে,‘আর যা-ই কস বাদল,লাইতে তোর বাঁশি না হুনলে মাছ ধইরা মজা পাই না।’ কালা বলে,‘তোর বাঁশির সুর হোনতে হোনতে রাইতটারেও ছোড মনে অয়।’ বাদল কিছু বলে না। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা উদাস উদাস ভাব ওর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ছাড়াবাড়িতে ওদের বাঁশি সংক্রান্ত আলাপ শুনে কাছে যায় সুন্দরী। সুন্দরীকে দেখে ওরাও রীতিমত থতমত খেয়ে যায়। সহসা ওরা মেয়েদের সঙ্গে মিশতে চায় না। তাছাড়া ছাবাড়িতে একলা কোন মেয়েকে স্বাভাবিকভাবে দেখে একটু ঘাবড়েই গেল ওরা। পল্লী গ্রামের ছেলে বলে কথা। আঙ্গুর ও কালাসহ অন্যরা উঠে চলে যায়। বাদল কিছুটা আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। বাদলের নির্লিপ্ততা সুন্দরীকে বিচলিত করে।

তবুও বলে,‘রাইতের বেলা বইশখালাতে বাঁশি বাজায় কেডা?’

সুন্দরীর এমন কথায় চমকে তাকায় বাদল।‘ক্যান? তা দিয়া আপ্নের কী কাম?’ বলে বাদল।

‘কাম আছে বইলাই তো হুনতে চাইলাম।’ জবাব দেয় সুন্দরী।
আমিই বাজাই। কোনো সমস্যা অইছে?
ও,আপ্নেরে তাইলে পাওয়া গেল। কিন্তু সমস্যা তো আছেই।
ক্যান,কী সমস্যা?
‘আপ্নের বাঁশির সুরে আমার ঘুম আহে না। মনডা ছটফট করে’। বলে সুন্দরী।
আপ্নে কানে তুলা দিয়া রাইখেন? আর মনডারে নাও এর কাছি দিয়া বাইন্দা রাইখেন।
তা-ও পারতাম না।
তাইলে আমি কী করতাম? বলে বাদল।
আমারে লয়া পালাইবেন? দাঁত দিয়ে শাড়ির আঁচল কামড়াতে কামড়াতে বলে সুন্দরী।
সুন্দরীর এমন নির্লজ্জ কথায় থমকে যায় বাদল। কোনো মেয়ে এতো অল্প সময়েই এমন কথা বলতে পারে?

বাদল হা করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর চমকিয়ে বলে ওঠে-
‘কন কি? পাগল অইয়া গেলেন নাকি? আপ্নের ত বিয়া অইছে,জামাই আছে’।

‘বিয়া অইছে বইলা কি আমার সব শেষ অইয়া গেছে নাকি? বাঁশির সুরে যদি মনে আগুন ধরে তাতে আমার কী দোষ?’ জবাব দেয় সুন্দরী।
‘আপ্নের লগে পালায়া গিয়া আমার কী লাভ? আপ্নের জামাই হুনলে ত আমারে মাইরালাইব। হুনছি হে নাকি বড় গুন্ডা। মজা করেন আমার লগে? যেইদিক থাইক্কা আইছেন,হেইদিকেই যান’। বলেই ছাড়াবাড়ি থেকে উঠে বাড়ির পথে পা বাড়ায় বাদল। সুন্দরী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বাদলের চলে যাওয়ার দিকে।

মাছ ধরতে গিয়ে কাজে মন বসছে না বাদলের। মাছ ছাড়া বাড়ি গেলে খবর আছে। বাবার বুকনি নির্ঘাত। বাঁশিও বাজায়নি আজ। বৃষ্টি হচ্ছে খুব। পুরনো ছাতাটা মাথার উপর ফুটিয়ে রাতভর বইশখালার বুকে নৌকায় বসে থাকে বাদল। সুন্দরীর কথাগুলো কানে বেজে ওঠে। একটা বিবাহিতা মেয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়। কত বড় দুঃসাহস। এর আগে এমন ঘটনা বাস্তবে দেখেনি বাদল। কেবল যাত্রা পালায় দেখেছে। ভাবতে ভাবতে বররা উঠিয়ে নৌকায় বসে পড়ে বাদল। রাতেরও প্রায় শেষ। আজ খুব একটা মাছ ধরা পড়েনি বররাতে। বাড়িও যেতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষণিকেই একটি মেয়ে পুরো উলট-পালট করে দিলো তাকে।

সুন্দরীর বাবা হতদরিদ্র একজন বর্গাচাষী। বর্ষা এলে জুলি ধানের আইলের ফাঁকে ফাঁকে হাতে বানানো সুতার জাল পেতে কৈ মাছ ধরে। পরিবার নিয়ে কোন রকম খেয়ে পরে বেঁচে আছে। এভাবেই টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে বাবার সংসারে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে সুন্দরী। মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পায় না সে। খুঁজেও কোনো লাভ নেই-জানে সুন্দরী। তবে প্রতি রাতের বাঁশির সুর তাকে উতলা করে দেয়। মনে মনে বাঁশিওয়ালাকে খুব আপন করে নিতে চায় সে। কিন্তু চাইলেই কি সব কিছু পাওয়া যায় এই জগতে। ‘বাঁশিওয়ালা ত আমারে চায়না’। বাঁশিওয়ালার ভাবনা টা মাথা থেকে কিছুতেই সড়াতে পারেনা সুন্দরী। আরও গভীর করে মুক্তির পথ খুঁজে সুন্দরী।

বৃষ্টি কিছুটা কমেছে এখন। গুড়ি গুড়ি পড়ছে। হঠাৎ মোল্লা বাড়ি থেকে অনেক হৈচৈয়ের মতো শোনা যায়। মোল্লা বাড়িটা বাদলের নৌকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ‘হায় হায় রে,অত লাইতে আবার কী অইল মোল্লা বাড়িতে?’ চিৎকার চেঁচামিচি কানে বিঁধলো বাদলের। ফাঁকা বইশখালা তে ইথারে ভেসে আসা সেই চিৎকার বুকে কাঁপন ধরায়। প্রতিধ্বনি হয় গ্রামের কিণারে। বাদল ভাবে,‘কেউ কি মারা গেল? নাকি সুন্দরীর কিছু অইল’।

সাতপাঁচ ভেবে কৌতূহল নিয়ে নৌকা টা জুরে চালিয়ে মোল্লা বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় বাদল। তখনও ফজরের আযান পড়েনি। বাদলের নৌকা গিয়ে ঠেকে সুন্দরীদের ঘাটে। বাড়িতে উঠে ভিড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখে-সেই মেয়েটি নিথর পড়ে আছে। যে কিনা গতকাল দুপুরে বাদলকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। এ সময় কেউ একজন বলছে,‘সুন্দরী লাইতে ধুতুরা ফুল খাইয়া পৃথিবী ছাইড়া চইলা গেছে গা। একবারও বুঝতে পারল না কেউ,ক্যান এই কামডা করলো’। আবার কেউ কেউ বলছে,‘ওর বদ-মাতাল জামাই টার দিত্বীয় বিয়ার খবর শুইন্না কষ্ট সইতে না পাইরা ধুতুরা ফুল খাইছে। ভালই করছে; অত কষ্টের জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল।’ কেবল বাদল ই জানে সুন্দরী কেন মরল এইভাবে। কিন্তু সে কথা কাউকে বলেনা বাদল। বাদল মুখটা ঘুরিয়ে নেয় অন্য দিকে, মনটাও। ভেতরে তার একটাই বার্তা,একটাই সংবাদ-‘সুন্দরী তকে ভালোবাসি। বড়ই ভালবাসি রে’।

অতঃপর ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসে বাদল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে মাথায় গামছা মুড়ি দিয়ে শক্ত হাতে লগি চালায়। কোষা নৌকা টা মেঘনার ঢেউকে পেছনে ফেলে দুরন্ত ঘোড়ার ন্যায় স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যায়। বাদলের চোখে ভেসে ওঠে সুন্দরীর মুখ। চোখ ভরা আশা,বুক ভরা ভালোবাসা। মানুষ কত অসহায়। বাদল ভাবে,রাতে বাঁশির সুর শুনতে না পেয়ে হয়তো বেশি কষ্ট পেয়েছে সুন্দরী। বইশখালার ঠিক মধ্যখানটায় নৌকায় লগি গেড়ে বসে বাদল-একা,নিঃসঙ্গ। জোছনার আলোটা মরে মরে আসছে। শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাস মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে বারংবার। কষ্টে, অসহ্য যন্ত্রণায় তার বুকের মধ্য থেকে উপচে পড়ছে যে জল তা উঠে আসছে চোখে অশ্রু হয়ে, গড়িয়ে পড়ছে তা চুইয়ে চুইয়ে দু’গাল বেয়ে বইশখালার শান্ত জলে। কোমরে গোজা বাঁশিটা বের করে হাতে নেয় বাদল। নেড়েচেড়ে দেখে বাঁশিটা। এক অসহনীয় কষ্ট অনুভূত হচ্ছে তার। আহারে, মেয়েটি সত্যিই বাঁচতে চেয়েছিল। বিয়ে হয়েছে তো তার কী দোষ? স্বামী আছে কথাটা নিয়ে ভাবতে থাকে। স্বামী তো আছেই। কিন্তু সে কেমন স্বামী? নামেমাত্র স্বামী। বউ এর কোন খোঁজ খবরই রাখেনা। সারাদিন গাঁজা নিয়েই পড়ে থাকে। ‘কী পেয়েছে তার কাছ থেকে? কিছুই পায়নি সুন্দরী। ভাবতে ভাবতে নিজের ওপর রাগে-সুন্দরীকে প্রত্যাখ্যানের দুঃখে বইশখালার শান্ত জলে বাঁশিটা অনেক দূরে ছুড়ে মারে। চাঁদের চিকচিকে আলোয় জলের ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে যায় হন্তারক বাঁশিটি। একসময় মিলিয়ে যায় দূরে কোথাও।

এরপর আর কোন দিন কেউ বাদলকে বাঁশি বাজাতে দেখেনি।

অনেকটা বছর কেটে গেল। আজ মুখ ভর্তি সাদা দাঁড়ি বাদলের। সে আর লাড় বাইতে যায়না। বর্ষা এলে তার দুই ছেলে কামাল আর জামাল ডিঙ্গি নৌকায় বেড় জালে মাছ ধরে। ওরাই সংসারের হাল ধরেছে এখন। বাদল ধর্ম কর্ম নিয়েই থাকে। সময়টা ইদানিং ভাল যাচ্ছেনা। শরীরে বাসা বেঁধেছে গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ নানা রোগ। প্রায়শই ঘরের দরজা বন্ধ করে জায়নামাজে সেজদায় পড়ে থাকে। একবার মক্তবের জুম্মার বয়ানে সে শুনেছিল,‘সেজদা অবস্থায় মারা গেলে নাকি বিনা হিসেবে বেহেশতে যাওয়া যায়’। সেজদায় পড়ে সে অবিরত কালেমা পড়ে যায়। মাঝে মাঝেই তার মনোযোগ কেটে যায়। অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগে। ‘যে আত্মহত্যা করে সে কি বেহেশতে যায়?’ এ প্রশ্ন শুধু আজকের নয়। এর ভার বহু বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে বাদল।

লেখক পরিচিতি: ফয়সুল আলম, জন্ম ১মার্চ,১৯৮৭; ভৈরবের কালিকাপুর গ্রামে। পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশুপালনে অনার্স ও পশুবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন। লেখালেখির শুরু স্কুলজীবন থেকেই। প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘তিন ঘন্টার কারাগারে’। দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করেন। পরিবেশ, অর্থনীতি, নাগরিক ও ব্যক্তি জীবনের নানাদিক তার লেখার উপজীব্য বিষয়।