সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সম্ভাবনার দুয়ারে বাংলাদেশ, প্রয়োজন স্থিতিশীলতা

ঐতিহাসিক বিনিয়োগ সম্মেলন

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ১৩ এপ্রিল ২০২৫ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন


বৃহস্পতিবারে পর্দা নামল চার দিনব্যাপী এক বর্ণাঢ্য ও বিশাল আয়োজনের— দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সম্মেলন। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এত বড় এবং এমন তাৎপর্যপূর্ণ বিনিয়োগ সম্মেলন আগে কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। এই অভূতপূর্ব সাড়া এবং সফল আয়োজনের পেছনে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত ব্যক্তিত্ব, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুগভীর প্রভাব ও ভাবমূর্তির অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর উপস্থিতি ও নেতৃত্ব এই সম্মেলনকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কেবল আগামীর বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ ও স্বপ্নময় চিত্রই প্রতিভাত হয়নি, বরং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী, বাংলাদেশ সরকার এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সংযোগ (নেটওয়ার্ক) স্থাপিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতের সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করেছে।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রায় সাড়ে চার শতাধিক বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীর প্রায় সকলেই বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক ধারণা নিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে গেছেন। তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদী। আলোচনা ও মতবিনিময়ে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি রূপরেখা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের অন্যতম প্রধান উদ্বেগ, অর্থাৎ সরকারি নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন বা সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নবনিযুক্ত নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদ তার উপস্থাপনা ও আলোচনার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ প্রবাহের জন্য ইতিবাচক। সম্মেলন শেষে এটি স্পষ্ট যে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী ও শক্তিশালী পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে বা আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তাদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত ও ধারাবাহিক যোগাযোগ রক্ষা করার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে বিনিয়োগের পথ আরও সুগম হবে।

এই বিপুল সম্ভাবনা ও ইতিবাচকতার পাশাপাশি, বিনিয়োগকারীরা কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেছেন, যা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ হলো— নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ, যেমন জ্বালানি ও অবকাঠামোর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি, দুর্নীতিকেও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা বিনিয়োগের ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতার শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘ইজি ডুয়িং বিজনেস’ বা সহজে ব্যবসা করার বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও উন্নত করার জন্য এই আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো দূর করা অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জগুলো যদি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা না যায়, তবে সম্মেলনের মাধ্যমে সৃষ্ট ইতিবাচক আবহ এবং অর্জিত সাফল্য ম্লান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, এই সম্মেলনের মর্মবস্তুকে ধারণ করে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে সত্যিকার অর্থেই একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ: আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সহজ ও দ্রুততর করা, নীতিগত স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা প্রদান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সম্পদের যোগান নিশ্চিত করা। মনে রাখতে হবে, ‘বেশি বিনিয়োগ মানে বেশি কর্মসংস্থান’। দেশে বেকারত্বের হার এখনো উদ্বেগজনক। আমরা বর্তমানে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশের সুবর্ণ সময় পার করছি। এই বিশাল কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। বেকারত্বের অবসান ঘটাতে পারলে তা দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রাকে বহুগুণে ত্বরান্বিত করবে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গত পাঁচ দশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ তার অপার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। তবে, প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের মধ্যে সেই দুর্বলতাগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে একটি আশার সঞ্চার হয়েছে। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাটা অমূলক নয়।

কিন্তু সকল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন এবং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য অপরিহার্য পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা। কোনো বিনিয়োগকারীই একটি অস্থিতিশীল, অনিশ্চিত ও সংঘাতময় পরিবেশে তাদের কষ্টার্জিত পুঁজি বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকারীদের মনে দ্বিধা এবং শঙ্কার জন্ম দেয়। তাই, দেশের সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের প্রতি আমাদের বিনীত কিন্তু জোরালো আহ্বান থাকবে, তারা যেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পারস্পরিক সাংঘর্ষিক রাজনীতি পরিহার করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আন্তরিক হন এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেন। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সকল রাজনৈতিক শক্তিকে দায়িত্বশীল হতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত, অর্থাৎ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত, নির্বিঘ্নে ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এর ব্যত্যয় ঘটলে, এই ঐতিহাসিক বিনিয়োগ সম্মেলনের সকল অর্জন, সকল প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে পড়বে এবং এর কোনো সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য থাকবে না। আসুন, সকলে মিলে অর্জিত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যাই।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।