সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেন করাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ১৫ এপ্রিল ২০২৫ | ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন


চট্টগ্রামের হৃদয় জুড়ে আজ কোন প্রয়োজনটি সবচেয়ে তীব্র সুরে বাজে? অগ্রাধিকারের সোনালী মুকুটখানি কার শিরে শোভা পাবে? এই জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়ালে পথিকের দ্বিধায় থমকে দাঁড়ানোই স্বাভাবিক। কেননা, এই নগরীর বুকে জমে থাকা সমস্যার মেঘমালা যে একটি বা দুটি নয়—তার বিস্তার দিগন্ত অবধি। অসংখ্য না-বলা কষ্ট যেন তার শিরায় শিরায়, প্রতিটিরই প্রয়োজন নিরাময়ের স্নিগ্ধ পরশ, এখনই। এই শহরের আকাশ-বাতাস জুড়ে ভাসে নানা আর্তি, নানা দাবি। কোনটিকে এগিয়ে রাখা হবে, কোনটিকে সামান্য অবকাশ দেওয়া হবে—এ যেন এক কঠিন সিদ্ধান্ত, এক গভীর অন্তর্দ্বন্দ্বের মুহূর্ত।

বর্ষার পদধ্বনি শোনা যায় দূরে, আর অমনি পুরোনো ভয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে—জলাবদ্ধতার দুঃস্বপ্ন। প্রতি বর্ষায় এই শহর যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের রূপ নেয়, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে যায়। তাই আসন্ন বর্ষার কথা ভেবে অনেকেই চাইবেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের অসমাপ্ত কাজগুলো দ্রুত শেষ হোক, নগরবাসী যেন জলবন্দী জীবন থেকে মুক্তি পায়। এই দাবি যৌক্তিক, এই প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার কর্ণফুলীর বুকে বিষণ্ণ দাঁড়িয়ে থাকা কালুরঘাট সেতুর দিকে তাকালে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। এই সেতুর দুই প্রান্তে অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চায় না, যানবাহনের দীর্ঘ সারি তৈরি করে সীমাহীন দুর্ভোগ। বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকা এই সেতুর ভাগ্য নির্ধারণের দাবিও তাই জোরালো, এর আশু সমাধানও কাম্য।

শহরের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে থাকা যানজটের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায় মানুষ। কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, মানসিক চাপ বাড়ে, নগরজীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। তাই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবিও সময়ের দাবি। এর পাশাপাশি রয়েছে নীরব ঘাতকের মতো ছড়িয়ে পড়া দূষণ—নদী হারিয়েছে তার স্বাভাবিক স্রোত, দখল আর দূষণে বিপন্ন; পাহাড় হারিয়েছে তার সবুজ আঁচল, নির্মম কর্তনে সে ক্ষতবিক্ষত। ফুটপাতগুলো পথচারীদের জন্য আর নিরাপদ নয়। এসবই চট্টগ্রামের গভীর ক্ষত, যার প্রতিটিরই নিরাময় প্রয়োজন। প্রতিটি সমস্যাই গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি সমাধানের দাবি রাখে।

কিন্তু এই সমস্ত ভোগান্তি, সমস্ত সংকট আর উদ্বেগকে ছাপিয়ে এক ভয়াল ছায়া আজ গ্রাস করেছে চট্টগ্রামের আকাশ। মানুষের মনে যে কষ্ট আজ সবচেয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে, যে ভয় হাড় হিম করে দিচ্ছে, তা হলো সড়কের নিরাপত্তা। বিশেষ করে, চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার যাওয়ার যে প্রধান সড়ক, তা যেন এক মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনের সংবাদপত্রে চোখ রাখলেই চোখে পড়ে দুর্ঘটনার করুণ খবর, স্বজন হারানোর আর্তনাদ। জলাবদ্ধতায় কষ্ট হয়, যানজটে সময় নষ্ট হয়, কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনা মুহূর্তে কেড়ে নিচ্ছে অমূল্য প্রাণ, একটি সম্ভাবনাময় জীবনকে নিভিয়ে দিচ্ছে চিরতরে। পরিবারগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে অনন্তকালের হাহাকার আর শূন্যতার গভীরে। যে বেদনা, যে অপূরণীয় ক্ষতি একটি দুর্ঘটনা বয়ে আনে, তার সঙ্গে অন্য কোনো দুর্ভোগের তুলনা চলে না। তাই আজ চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের হৃদয়ের আকুতি—অন্য সবকিছুর আগে এই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হবে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হোক এই মুহূর্তের প্রধানতম কর্তব্য।

পরিসংখ্যানের খাতা খুললে ভয়াবহতার চিত্রটি আরও স্পষ্ট, আরও মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্যে আমরা দেখতে পাই এক উদ্বেগজনক বাস্তবতা। শুধু এই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কেই, এই তো ২০২৫ সালের প্রথম তিনটি মাস—জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই স্বল্প সময়েই ২৭টি মারাত্মক দুর্ঘটনায় ঝরে গেছে ৪২টি তাজা প্রাণ। আহতের সংখ্যা ৫৬, যাদের অনেকেই হয়তো আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। আর যদি পিছনের দিকে তাকাই, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত—এই চার বছরে একই সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা ২২৪! এ কি কেবলই সংখ্যা? নাকি ২২৪টি পরিবারের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, ২২৪টি অসমাপ্ত গল্প?

এই তো সেদিনকার কথা, ঈদের আনন্দ যখন ছুঁয়ে গেছে বাংলার প্রতিটি ঘর, ঠিক সেই ছুটির দিনগুলোতে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে এই মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া নামক একটি ছোট্ট অংশে তিনটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেড়ে নিল ১৬টি জীবন! আহত হলেন আরও অন্তত ৩০ জন। ঈদের বাড়ি ফেরা বা প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দযাত্রা নিমেষেই পরিণত হলো বিভীষিকায়। শুধু চুনতি জাঙ্গালিয়া নয়, এই ১৫৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পথের প্রায় প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি অংশে ওত পেতে আছে বিপদ। লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু—কোথাও যেন স্বস্তি নেই। ছোট-বড় দুর্ঘটনা যেন এই সড়কের নিত্যদিনের সঙ্গী। আক্ষরিক অর্থেই এ সড়ক আজ এক সাক্ষাৎ মৃত্যুর ঠিকানা, এক দীর্ঘশ্বাসের করিডোর।

বর্তমানে চট্টগ্রামের জনমানুষের আলোচনায়, উদ্বেগে, দাবিতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে এই সড়ক দুর্ঘটনার কথা। একটাই আর্তি—এই মৃত্যুফাঁদ থেকে আমাদের বাঁচান। সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনুন। দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয় সামনে এসেছে। মূল কারণ হিসেবে বারবার উঠে আসছে সড়কের অপ্রশস্ততা। এই গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি অবিশ্বাস্যরকম সরু। এর পাশাপাশি রয়েছে বর্ষায় বা লোনা পানিতে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া, চালকদের অদক্ষতা এবং বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ভয়ঙ্কর প্রবণতা, সড়কের অসংখ্য বিপজ্জনক বাঁক, নিয়ম না মেনে ওভারটেক করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, মহাসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ পথে ধীরগতির ও নিষিদ্ধ ছোট ছোট যানবাহনের অবাধ চলাচল, ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি যাত্রী বা মালামাল নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল এবং সড়কের দুই পাশের উঁচু-নিচু, ভাঙাচোরা বা সংকুচিত অবস্থা। কিন্তু এই সব কারণের ভিড়েও সবচেয়ে বড় ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এর অপ্রশস্ততা। প্রয়োজনের তুলনায় এই সড়ক সংকীর্ণ, যা প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে।

আর এ কারণেই দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর বাঁচার আকুতি থেকে জোরদার হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটিকে ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি। এই দাবি এখন আর কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সংগঠনের নয়, এ দাবি এখন চট্টগ্রামের গণমানুষের। সাধারণ মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক কর্মী, সামাজিক সংগঠন—সবাই আজ এক কাতারে। মানববন্ধন হচ্ছে, বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে, সভা-সমাবেশে একটাই আওয়াজ উঠছে—চার লেন চাই, নিরাপদ সড়ক চাই। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু করে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া—সর্বত্রই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই প্রাণের দাবি। মানুষ চায় এই মরণফাঁদ থেকে মুক্তি, এই বিভীষিকার অবসান।

একবার ভাবুন, দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে যাওয়ার এটিই একমাত্র সড়কপথ। প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক, সাধারণ যাত্রী, এবং পণ্যবাহী যানবাহন এই সড়ক ব্যবহার করে। অথচ এর বিশাল অংশের প্রশস্ততা মাত্র ১৮ থেকে ৩৪ ফুটের মধ্যে সীমাবদ্ধ! এই সংকীর্ণ পথ দিয়েই চলে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার এবং অসংখ্য ছোট যানবাহন। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে—১৫৯ কিলোমিটারের এই তুলনামূলক ছোট দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় লাগছে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি, কখনও কখনও আরও বেশি। পুরো সড়কজুড়ে রয়েছে অসংখ্য বিপজ্জনক বাঁক, যা চালকদের জন্য কঠিন পরীক্ষার শামিল। সড়কের দুই পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বহু হাটবাজার, ছোট-বড় শহর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মূল সড়কের সাথে সরাসরি মিশেছে গ্রামের পর গ্রাম থেকে আসা অসংখ্য ছোট ছোট উপসড়ক, যেখান থেকে হঠাৎ করেই যানবাহন বা মানুষ চলে আসে মূল সড়কে। এই সবকিছু মিলিয়ে মহাসড়কের বহু অংশই পরিণত হয়েছে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ মৃত্যুফাঁদে।

বিশেষজ্ঞরা এবং স্থানীয়রা কিছু এলাকাকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে লোহাগাড়া শহর এলাকা, যেখানে প্রায়শই যানজট এবং দুর্ঘটনা ঘটে। রয়েছে চুনতির সেই ভয়াল জাঙ্গালিয়া এলাকা, যা অল্প কদিনেই কেড়ে নিল বহু প্রাণ। চকরিয়ার ইসলামনগর, ইমাম বুখারি মাদ্রাসা এলাকা, চকরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এলাকাও অত্যন্ত বিপজ্জনক। লক্ষ্যারচর জিদ্দা বাজার মোড় বা টার্নিং পয়েন্ট, মালুমঘাটের সেই কুখ্যাত ছগিরশাহকাটা ঢালা, ডুলাহাজারার পাগলিরবিল এলাকা, খুটাখালী জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন অংশ, ঈদগাঁওয়ের নাপিতখালী এবং রামু রাবারবাগান এলাকা—এই নামগুলো শুনলেই এখন মানুষের মনে ভেসে ওঠে দুর্ঘটনার বিভীষিকা। এসব স্থানে ঝড়ছে রক্ত, ঝরছে চোখের জল।

দুর্ঘটনা কেবল জীবনপ্রদীপই নিভিয়ে দিচ্ছে না। যারা প্রাণে বেঁচে যাচ্ছেন, তাদের অনেকেই বরণ করছেন চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব। কেউ হারাচ্ছেন হাত, কেউ পা, কেউ বা মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে সারাজীবনের জন্য শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছেন। কর্মক্ষম মানুষটি পরিণত হচ্ছেন পরিবারের বোঝায়। তাদের স্বপ্নগুলো দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে এক নিমেষে। এই যে শত শত মানুষ এবং তাদের পরিবারকে প্রতিনিয়ত এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তা থেকে রক্ষা পেতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে প্রশস্ত করার কাজটিই এখন সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে অগ্রগণ্য। এর কোনো বিকল্প নেই।

চট্টগ্রামবাসীর এই প্রাণের দাবি, এই বাঁচার আকুতি নতুন নয়। বহু বছর ধরে এই দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। বারবার এই দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই এই সড়কের উন্নয়ন অপরিহার্য। প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়াতে, পর্যটন শিল্পের আরও বিকাশ ঘটাতে, সর্বোপরি দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা সহজ ও নিরাপদ করতে এই মহাসড়কের আধুনিকায়ন ও প্রশস্তকরণ অত্যন্ত জরুরি। এই সড়ক শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি দেশের অর্থনীতি ও পর্যটনের লাইফলাইনও বটে। এর উন্নয়ন পুরো অঞ্চলের জন্যই মঙ্গলজনক।

সরকার যে এই দাবির বিষয়ে অবগত নয়, তা বলা যাবে না। অতীতে বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটিকে চার লেনে উন্নীত করার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও করেছিল। কিন্তু তারপর কী হলো? সেই সম্ভাব্যতা সমীক্ষার প্রতিবেদন হয়তো ফাইলের নিচে চাপা পড়ে রইল, প্রকল্পটি আর বাস্তবায়িত হলো না। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, নতুন করে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলছে। কিন্তু এই সমীক্ষার চক্র আর কতদিন চলবে? কবে হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত? কবে শুরু হবে কাজ? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। মানুষের মনে জমেছে হতাশা আর ক্ষোভ।

অবশ্য একেবারে কিছুই যে হয়নি, তা নয়। সড়কের কিছু অংশে যানজট কমাতে এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোতে চাপ কমাতে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। পটিয়া, দোহাজারি, লোহাগাড়া এবং চকরিয়ায় বাইপাস সড়ক এবং সাতকানিয়ার কেরানীহাটে একটি উড়ালসড়ক নির্মাণের জন্য ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেক অনুমোদন দিয়েছিল ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতো, দুর্ঘটনাও হয়তো কমত। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, প্রকল্পটি অনুমোদনের পর প্রায় দেড় বছর (১ বছর ৫ মাস ১৫ দিন, আজকের এই ১৫ই এপ্রিল) অতিক্রান্ত হতে চললেও, এখনো মাঠ পর্যায়ে এর কাজই শুরু হয়নি! কেবল অনুমোদন দিয়েই কি দায়িত্ব শেষ? বাস্তবায়ন না হলে সেই অনুমোদনের মূল্য কী?

তাহলে শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালোটা কী? যে মূল দাবি—পুরো মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ—সেটিও ‘বিশ বাঁও জলে’, আবার যানজট ও দুর্ঘটনা কমাতে যে বিকল্প বাইপাস ও উড়ালসড়কের প্রকল্প নেওয়া হলো, সেটিও কাগজে-কলমেই বন্দী। বছরের পর বছর ধরে চলছে কেবল সমীক্ষার পর সমীক্ষা, প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি। আর তার বিপরীতে প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুর্ঘটনা আজ যেন এক ভয়াল মহামারির রূপ ধারণ করেছে, যা নীরবে গ্রাস করে চলেছে অসংখ্য জীবন।

না, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। একটি সভ্য সমাজে, একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের কাছে এর চেয়ে বড় অগ্রাধিকার আর কিছু হতে পারে না। মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর কী আছে? যেকোনো উন্নয়ন, যেকোনো অগ্রগতির মূল লক্ষ্যই তো হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণ, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। তাই অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ কাজকে সামান্য সময়ের জন্য থামিয়ে রেখে হলেও, এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে নিরাপদ করার কাজটি, বিশেষ করে এটিকে প্রশস্ত করে ছয় লেনে উন্নীত করার উদ্যোগটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এটাই এখন সময়ের দাবি, এটাই চট্টগ্রামের মানুষের বাঁচার আকুতি। মানুষের জীবন রক্ষা করাই হোক প্রথম এবং প্রধানতম কর্তব্য।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।