
আয়নায় আমরা আজ কীসের প্রতিবিম্ব দেখছি? এক অচেনা, ভাঙা আয়নায় হতবিহ্বল এক জাতির মুখ। যে মুখে লেগে আছে গুরুর রক্তের ছিটে। শনিবার (৮ নভেম্বর), রাজধানীর শাহবাগের রাজপথ ভিজেছে সেই রক্তে, যাঁদের হাত ধরে একটি শিশু প্রথমবার বর্ণপরিচয় শেখে, প্রথম ‘অ-আ’ বলতে শেখে। সেই পূজনীয় হাতগুলোই আজ পুলিশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হলো, থেঁতলে গেল। যে শিক্ষকেরা জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর, আজ সেই মেরুদণ্ডকেই রাজপথে পিষে ফেলা হলো।
তাঁদের অপরাধ কী ছিল? পৌনে চার লাখ প্রাথমিক শিক্ষকের এই আগুন-জ্বলা বাজারে অপরাধ শুধু একটাই—তাঁরা একটুখানি সম্মান চেয়েছিলেন। তাঁরা এই রাষ্ট্রীয় অপমান থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন যে, কেন একজন অষ্টম শ্রেণি পাস করা গাড়িচালক ১২তম গ্রেডে বেতন পাবেন, আর সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষককে ১৩তম গ্রেডে পড়ে থাকতে হবে? তাঁরা শুধু ‘তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী’ হয়ে থাকার গ্লানি থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন।
এই নব্য-আগুনের বাজারে তাঁরা কী এমন রাজপ্রাসাদ চেয়েছিলেন? যখন পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকা ছুঁই ছুঁই, আর কাঁচামরিচের দাম ১৩০ টাকা, তখন এই শিক্ষকেরা শুধু চেয়েছিলেন তাঁদের বেতনের অংকটা যেন বাঁচার মতো হয়। তাঁদের এই আকুতি কি রাষ্ট্রের কানে পৌঁছানোর কথা ছিল না?
পৌঁছায়নি। অথবা রাষ্ট্র হয়তো অন্য কিছু শোনাতে চেয়েছে। শিক্ষকেরা চেয়েছিলেন আলোচনা, সরকার উপহার দিলো জলকামান। শিক্ষকেরা চেয়েছিলেন সম্মান, তাঁদের দিকে ধেয়ে এলো সাউন্ড গ্রেনেড আর কাঁদানে গ্যাস। যে দেশে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার ব্যক্তিগত লন্ডন সফরের একটি হোটেল কক্ষের ভাড়াই এক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় বলে জনশ্রুতি আছে, সেই দেশ তার শিক্ষকদের সামান্য দাবির জবাবে এতটা নির্মম, এতটা নির্দয় হয়ে ওঠে কী করে?
সরকার কি পারতেন না এই গুরুজনদের ভিন্ন উপায়ে, সম্মানের সাথে ম্যানেজ করতে? অবশ্যই পারতেন। কিন্তু আজ যেভাবে শিক্ষকদের ওপর পুলিশ চড়াও হলো, সেই দৃশ্য কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই শিক্ষকেরা কোনো বিচ্ছিন্ন জনতা নন, তাঁরা প্রতিটি পরিবারের অংশ। আজ রাজপথে তাঁদের লুটিয়ে পড়া সম্মান দেখেছে তাঁদেরই ছাত্ররা। আমরা আমাদের সন্তানদের কোন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? আমরা তাদের কী বার্তা দিলাম?
শিক্ষকদের ওপর যখন শাহবাগে পুলিশি তাণ্ডব চলছিল, ঠিক সেই সময়েই হয়তো কয়েকশ কিলোমিটার দূরে খুলনায় বসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এই আন্দোলনকে ‘যৌক্তিক’ বা ‘অযৌক্তিক’ প্রমাণের তত্ত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলছিলেন, প্রধান শিক্ষকেরাই যেখানে সবেমাত্র দশম গ্রেড পেয়েছেন, সেখানে সহকারী শিক্ষকেরা এক লাফে কীভাবে দশম গ্রেড চান?
জনাব উপদেষ্টার এই শীতল আমলাতান্ত্রিক বিশ্লেষণ ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথের শিক্ষকদের কান্না আর আর্তনাদের সাথে এক ভয়াবহ পরিহাস। তিনি হয়তো জানেন না, কিংবা জেনেও মানতে চান না যে, ওই প্রধান শিক্ষকেরাও এই দশম গ্রেড সরকারের উপহার হিসেবে পাননি, বছরের পর বছর আইনি লড়াই করে, আদালতের সিঁড়ি ক্ষয় করে তাঁরা তা আদায় করেছেন। সহকারী শিক্ষকেরাও আজ সেই পথেই হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন।
অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার যখন বলেন যে, তিনি ১১তম গ্রেডের জন্য ‘লবিং’ করছেন, তখন বোঝা যায়—এই শিক্ষকেরা যাদের কাছে দাবি জানাচ্ছেন, তাঁরা আসলে কতটা বিচ্ছিন্ন। তিনি যখন বলেন, ‘এই মুহূর্তে আন্দোলনে যাওয়া আমার কাছে খুব যৌক্তিক মনে হয় না’, তখন তিনি আসলে ভুলে যান যে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই মানুষ পথে নামে। তিনি যখন পড়াশোনা বিঘ্নিত হলে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন, তখন তিনি আসলে হুমকির পথই বেছে নেন। এই ‘কঠোর ব্যবস্থা’রই কি এক ছোট মহড়া আমরা আজ শাহবাগে দেখলাম?
না, শিক্ষকেরা দমে যাননি। পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে, শতাধিক সহকর্মীকে আহত অবস্থায় দেখেও তাঁরা পিছু হটেননি। ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’-এর নেতা মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ জানিয়েছেন, এই হামলার প্রতিবাদে তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। পাশাপাশি সারা দেশের বিদ্যালয়গুলোতে চলবে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি।
এই সিদ্ধান্ত এক গভীরতর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। শহীদ মিনার—আমাদের ভাষা আর আত্মপরিচয়ের প্রতীক। শিক্ষকেরা আজ সেই আত্মপরিচয়ের পাদপীঠেই অবস্থান নিচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের সম্মান ফিরিয়ে আনার লড়াই শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি তিনটি—সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড, শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি, এবং ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড। এগুলো কোনো অযৌক্তিক আবদার নয়, এগুলো তাঁদের প্রাপ্য অধিকার।
আজকের এই পুলিশি হামলা কেবল শিক্ষকদের গায়েই লাগেনি, এ আঘাত লেগেছে আমাদের সবার বিবেকে। এই রক্তক্ষরণ শুধু শাহবাগের পিচঢালা পথেই হয়নি, এ ক্ষরণ হয়েছে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের হৃদয়ে। আজ শিক্ষক কাঁদছেন, আর সেই কান্না দেখে হাসছে আমলাতন্ত্রের অট্টালিকা। এই ভাঙা আয়নায় আমরা যে মুখ দেখছি, তা আমাদের লজ্জিত করে, ব্যথিত করে। এই লজ্জা গোটা জাতির।
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন তার নাগরিকদের যৌক্তিক দাবির বিপরীতে পেশিশক্তি প্রদর্শন করে, তখন বুঝতে হবে সে তার নৈতিক ভিত্তি হারিয়েছে। আজ সরকার শিক্ষকদের বিপরীতে পুলিশকে দাঁড় করিয়ে ঠিক সেই নৈতিক পরাজয়ই বরণ করলো। উপদেষ্টা মহোদয় যে আর্থিক সংশ্লেষের কথা বলছেন, যে বলছেন শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বেশি—সেই যুক্তি তো বড়জোর কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হতে পারে, একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের নয়। একটি রাষ্ট্র তার শিক্ষকদের বেতন-ভাতাকে ‘ব্যয়’ হিসেবে দেখে না, ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে দেখে। আজ সেই বিনিয়োগের দর্শনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো।
যে শিক্ষকেরা আজ মার খেলেন, তাঁরাই তো কাল শ্রেণিকক্ষে ফিরে গিয়ে আমাদের সন্তানদের শেখাবেন সুনাগরিকত্বের পাঠ, শেখাবেন রাষ্ট্রকে ভালোবাসার কথা। কিন্তু কোন মুখে তাঁরা এই রাষ্ট্রের জয়গান গাইবেন? যে রাষ্ট্র তাঁদের সম্মান দিতে জানে না, যে রাষ্ট্র তাঁদের পেটের ভাতের ন্যায্য দাবির জবাবে লাঠি চালায়, সেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের পাঠ তাঁরা কীভাবে দেবেন? এই ভাঙা মন নিয়ে, এই শারীরিক যন্ত্রণা আর মানসিক অপমান বয়ে বেড়িয়ে তাঁরা কীভাবে কোমলমতি শিশুদের মনে স্বপ্নের বীজ বুনবেন? সরকার আজ শিক্ষকদের রাজপথে পিটিয়ে আদতে এই প্রশ্নগুলোর জন্ম দিয়েছে, যা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়াতেই আঘাত হেনেছে। এই ক্ষত শুকোতে অনেক সময় লাগবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।