বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

শুল্ক-সংগ্রামে জয়: পর্দার আড়ালে কী?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৫ | ১১:৫৪ অপরাহ্ন

নজরুল কবির দীপু
অবশেষে দীর্ঘ তিন মাসের দমবন্ধ করা অনিশ্চয়তার অবসান হলো। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর, বিশেষ করে তার সোনালি আঁশ তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর যে কালো মেঘ জমেছিল, তা যেন এক লহমায় কেটে গেল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল আলোচনার পর বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত শাস্তিমূলক শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে এক লাফে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে।

এটি নিছক কোনো সংখ্যাগত পরিবর্তন নয়; এটি এক স্বস্তির নিঃশ্বাস, যা দেশের রপ্তানি খাতের শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালন করছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন একে ‘ঐতিহাসিক ও সুস্পষ্ট কূটনৈতিক সাফল্য’ বলে অভিহিত করেন, তখন তা কেবল কথার কথা থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে এক কঠিন বাস্তবতা।

এই স্বস্তির গভীরতা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই উদ্বেগজনক দিনগুলোতে। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বাণিজ্য ঘাটতি থাকা দেশগুলোর ওপর ‘পাল্টা শুল্ক’ নামক এক অর্থনৈতিক খড়্গ ঝুলিয়ে দেয়। সেই খড়্গের এক নির্মম আঘাত এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপর—প্রাথমিকভাবে ৩৭ শতাংশ শুল্ক, যা ছিল এই অঞ্চলের মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ। এই ঘোষণা ছিল পোশাক শিল্পের জন্য এক অশনিসংকেত, যা প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিকের জীবন-জীবিকা এবং দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল।

প্রথম দফা আলোচনার পর যখন সেই হার মাত্র দুই শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হলো, তখন তা ছিল মরুভূমিতে এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো—প্রয়োজনের তুলনায় এতটাই অপ্রতুল যে, হতাশা কমার বদলে আরও ঘনীভূত হয়েছিল। বিজিএমইএ সভাপতির কথায়, “অনিশ্চয়তার মধ্যে ব্যবসা করা কঠিন,” যা ছিল সে সময়ের প্রতিটি শিল্পোদ্যোক্তার মনের কথা। মার্কিন ক্রেতারাও আদেশের খাতা হাতে নিয়ে ‘দেখি কী হয়’ নীতিতে চলছিল, যা আমাদের রপ্তানি বাজারকে এক প্রকার স্থবির করে দিয়েছিল।

এই প্রতিকূল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে কূটনৈতিক দাবার চাল দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এটি ছিল এক উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই, যেখানে কেবল দর-কষাকষি নয়, প্রয়োজন ছিল কৌশলগত দূরদর্শিতার। দ্বিতীয় দফা আলোচনার আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং বিমানসহ অন্যান্য পণ্য কেনার যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নেয়, তা ছিল সেই দাবার বোর্ডের সবচেয়ে কার্যকর চাল।

ওয়াশিংটনের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল, বাংলাদেশ যেন তাদের কাছ থেকে আমদানি বাড়ায়। ঢাকার এই একটি সিদ্ধান্তে সেই চাওয়া পূরণ হওয়ার ইঙ্গিত মিলল এবং বরফ গলতে শুরু করল। ফলস্বরূপ, আরও ১৫ শতাংশ শুল্ক হ্রাস পেয়ে চূড়ান্ত হার দাঁড়াল ২০ শতাংশ। এটি কেবল একটি বাণিজ্যিক বিজয় নয়, এটি সময়ের প্রয়োজনে নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্তের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের ভাষায়, এক ‘বড় ধরনের অনিশ্চয়তার অবসান’ ঘটাল।

এই নতুন শুল্কহার বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মাঠে এক নতুন সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। আমাদের প্রধান দুই প্রতিযোগী—ভারত (২৫%) এবং চীন (৩০%)—এখন আমাদের চেয়ে বেশি শুল্কের বোঝায় ভারাক্রান্ত। যদিও ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের হার সমান (২০%) এবং পাকিস্তান সামান্য সুবিধায় (১৯%) রয়েছে, তবুও বিশ্বের শীর্ষ দুই পোশাক সরবরাহকারী দেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকাটা আমাদের জন্য এক বিরাট সুযোগ। এই শুল্ক ছাড় চীনের পর দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক হিসেবে আমাদের অবস্থানকে কেবল সুসংহতই করবে না, বরং ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের নতুন শক্তি জোগাবে।

কিন্তু প্রতিটি মুদ্রারই দুটি পিঠ থাকে। এই বিরাট সাফল্যের উল্টো পিঠেও কিছু কাঁটার মতো প্রশ্ন বিঁধে রয়েছে। শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র কীসের বিনিময়ে এই ছাড় দিল? বোয়িং ক্রয়ের সিদ্ধান্তটি কি শুধুই একটি স্বচ্ছ বাণিজ্যিক চুক্তি, নাকি এটি একটি সোনালি খাঁচা, যার আড়ালে রয়েছে আমাদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো গোপন শর্ত?

গণমাধ্যমে ‘গোপন সমঝোতা স্মারক’ নিয়ে যে গুঞ্জন, তা জনমনে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহল ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অধিকার রয়েছে যেকোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার। যদি এই চুক্তির অংশ হিসেবে আমাদের বলে দেওয়া হয় যে, ‘অমুক দেশ থেকে তোমরা পণ্য কিনতে পারবে না’, তবে তা হবে আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর এক সরাসরি হস্তক্ষেপ। এমন কোনো শর্ত যদি সত্যিই থেকে থাকে, তবে আজকের এই সাফল্য ভবিষ্যতের জন্য এক বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হানের সতর্কবাণীটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এই সাফল্যকে সাধুবাদ জানালেও আত্মতুষ্টিতে ভেসে যাওয়ার বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য আজও ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার’ মতো—পুরোটাই পোশাকশিল্প-নির্ভর। এই এককেন্দ্রিকতা একটি বিপজ্জনক দুর্বলতা।

ভবিষ্যতের যেকোনো বৈশ্বিক ঝড়ে এই একটি ঝুড়ি উল্টে গেলে আমাদের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এই স্বস্তির মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হবে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনা—চামড়া, পাট, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণসহ অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা।

সবশেষে প্রশ্নটি স্বচ্ছতার। কূটনীতির স্বার্থে আলোচনার টেবিলে অনেক কিছু গোপন রাখতে হয়, এটি সত্য। কিন্তু চুক্তি যখন চূড়ান্ত, তখন তা জনগণের সম্পত্তি। জনগণের জানার অধিকার রয়েছে, কীসের বিনিময়ে এই সাফল্য অর্জিত হলো। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশা থাকে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা।

আশা করি, সরকার এই চুক্তির পূর্ণ বিবরণ জনসমক্ষে প্রকাশ করে সেই প্রত্যাশা পূরণ করবে। এই কূটনৈতিক বিজয় তখনই সত্যিকারের গণমানুষের বিজয়ে পরিণত হবে, যখন আমরা নিশ্চিত হব যে এর জন্য জাতীয় স্বার্থের চুল পরিমাণও বিসর্জন দেওয়া হয়নি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।