
“আর পোয়া আইয়ির, আই চাইয়ুম।” (আমার ছেলে আসছে, আমি দেখব)। “আই থোয়াই চাইর।” (আমি খুঁজে দেখি)।
এটি কোনো সাধারণ প্রতীক্ষা ছিল না। এটি ছিল আনোয়ারার হাইলধরে এক বৃদ্ধা মায়ের তার খুন হওয়া ছেলের লাশের জন্য পাগলের মতো অপেক্ষা। যে ছেলেকে তার অন্য এক ছেলে পশুর মতো পিটিয়ে হত্যা করেছে।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বিকেলে নাজিম উদ্দীনের মৃত্যুর পর থেকে আজ (বুধবার) সন্ধ্যা পর্যন্ত—হাসপাতালের ফ্লোর থেকে হাইলধরের বাড়ির উঠান পর্যন্ত—প্রতিটি দৃশ্যই ছিল কেবলই শোক, কান্না আর খুনিদের প্রতি তীব্র ঘৃণার।
মায়ের যে প্রতীক্ষা শেষ হলো বিলাপে
আজ সন্ধ্যায় ময়নাতদন্ত শেষে নাজিমের লাশ যখন হাইলধরের বাড়িতে আনার প্রস্তুতি চলছিল, তার ঠিক আগমুহূর্তের দৃশ্য ছিল সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। নাজিমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নাজিমের অতি বৃদ্ধা মা উঠানে পাগলের মতো পায়চারি করছেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তার ছেলে আর নেই। তিনি বিলাপ করে প্রতিবেশীদের বলছিলেন, “আমার ছেলে আসছে, আমি তাকে দেখব।”
প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, ‘তারা লাশ এখানেই আনবে।’ কিন্তু মায়ের মন মানছিল না। তিনি বিলাপ করে এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন, “আই থোয়াই চাইর।” (আমি খুঁজে দেখি)।
মায়ের এই খোঁজাখুঁজি, এই প্রতীক্ষা শেষ হয় যখন অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে ওঠে। নাজিমের লাশবাহী খাট উঠানে রাখতেই সেই মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আর দাঁড়াতে পারেননি, উঠানের কাদামাটিতে বসেই তিনি তারস্বরে সেই বিলাপ শুরু করেন, যা আনোয়ারার আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তোলে: “অ পুতলে পুত… নেজাইম্মে পুত…!” (ও আমার ছেলে… আমার নাজিম ছেলে…!)
তার এই আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত শত শত গ্রামবাসীর মধ্যে। নাজিমের বোন পারভিন আক্তার কান্নায় মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকেন। স্ত্রী মুক্তা জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন বার বার। তার বড় ছেলেও বাবার কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিল। নাজিমের মামাতো ভাই সহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশীরা এই শোক সইতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
হাসপাতাল থেকে জানাজা: জনস্রোত আর ঘৃণা

মঙ্গলবার বিকেলে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসক ডা. তারেক নিজামী যখন নাজিমের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেন, তখনই যেন হাসপাতালের ফ্লোর কেঁপে ওঠে। স্ত্রী মুক্তা অবুঝ সন্তানকে কোলে নিয়ে আহাজারি করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার বুকফাটা চিৎকার ছিল একটাই—”আমার তিন সন্তান এতিম হয়ে গেলো… আমি এখন কোথায় যাবো…।”
হাসপাতালের এই শোকের চিত্রের রেশ ধরেই আজ (বুধবার) সন্ধ্যায় পুরো হাইলধর গ্রাম নাজিমকে শেষ বিদায় জানাতে এবং এই নির্মমতার প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হয়।
বিচারহীনতার বিরুদ্ধে জানাজায় জনবিস্ফোরণ
আজ সন্ধ্যা ৭টায় নাজিমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এটি কোনো সাধারণ জানাজা ছিল না, এটি ছিল এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণজমায়েত। শত শত বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী নাজিমের জানাজায় অংশ নেয়। তাদের উপস্থিতি ছিল খুনিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর বিচারহীনতার চেষ্টার বিরুদ্ধে এক সোচ্চার প্রতিবাদ।
যেভাবে খুনের শুরু ও একুশে পত্রিকার লড়াই
উল্লেখ্য, গত ২৬ অক্টোবর পৈত্রিক সম্পত্তির বিরোধের জেরে নাজিম উদ্দীনকে ‘গরু চোর’ অপবাদ দেয় তারই আপন বড় ভাই আহমদ ছফা ও ভাতিজা রিটন। এই মিথ্যা অপবাদ প্রতিষ্ঠা করতে তারা মোজাফফর প্রকাশ কেনো নামে এক ব্যক্তিকে মারধর করে নাজিমের নাম বলিয়ে নেয়। এরপর, প্রকাশ্য দিবালোকে, জনসমক্ষে তারা নাজিমকে ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনে এবং দড়ি দিয়ে বেঁধে লাঠি ও রড দিয়ে ‘সাপের মতো’ পিটিয়েছিল।
ভয়াবহ সেই মারধরের ভিডিও থাকা সত্ত্বেও আনোয়ারা থানা পুলিশ গত এক সপ্তাহ মামলা নিতে গড়িমসি করে। পরিবারটির অভিযোগ ছিল, আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় এবং টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করায় কেউ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছিল না। ওসি মনির হোসেন ভুক্তভোগীর পরিবারকে ‘আদালতে যাওয়ার’ পরামর্শ দেন এবং একুশে পত্রিকার প্রতিনিধি জিন্নাত আয়ুবকে নিউজ না করতে অনুরোধ করেন।
গত ১ নভেম্বর একুশে পত্রিকায় এই নির্মমতা এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে “সাপের মতো পিটিয়ে ভাইকে আইসিইউতে…“ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
কলমের জোরে আসামি গ্রেপ্তার, তবু শেষরক্ষা হলো না
প্রতিবেদন প্রকাশের মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে যে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল, সেই পুলিশই নাটকীয়ভাবে অভিযানে নামে এবং প্রধান অভিযুক্ত ভাই আহমদ ছফাকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, গ্রেপ্তারের পরদিনই তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে যান। মামলাও রুজু হয়। কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল।
একুশে পত্রিকার সেই প্রতিবেদন নাজিমের বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারলেও, তার জীবন বাঁচাতে পারলো না। নাজিমের মৃত্যুতে সেই হত্যাচেষ্টা মামলাটি এখন ৩০২ ধারার (হত্যা) মামলায় রূপান্তরিত হলো।
নাজিমের তিন এতিম সন্তান আর “অ পুতলে পুত” বলে চিৎকার করতে থাকা তার বৃদ্ধা মায়ের এই আর্তনাদের বিচার এখন রাষ্ট্র কবে নিশ্চিত করবে, সেই প্রশ্নই এখন আনোয়ারার আকাশে-বাতাসে। প্রধান অভিযুক্ত আহমদ ছফা গ্রেপ্তারের পরদিনই জামিনে মুক্ত হয়ে যাওয়ায় এবং এই পৈশাচিকতার মূল হোতা ভাতিজা রিটন এখনো পলাতক থাকায় ভুক্তভোগী পরিবারটি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।