শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভেটেরিনারিতে পশু-চিকিৎসায় হয়রানি-দুর্ব্যবহার, ভিসি বলছেন অন্য কথা

প্রকাশিতঃ ৭ এপ্রিল ২০২১ | ৬:৫২ অপরাহ্ন

জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : পশু-পাখির সেবা প্রদান করা যাদের কাজ তাদের কাছেই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন পশু পালনকারীরা। প্রতিনিয়ত দুর্ব্যবহার আর চিকিৎসা না দেওয়ার হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে পশুর চিকিৎসাপ্রত্যাশীদের।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অবহেলা, শিক্ষানবীশ চিকিৎসকদের ভুল ও দায়সারা চিকিৎসার কারণে বাঁচার জন্য হাসপাতালে যাওয়া পশুগুলোর প্রায়শ মৃত্যু হচ্ছে। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের এই চিত্র নতুন নয়।

গত ২০ মার্চ ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) পেট হাসপাতালে নিজের পোষা বিড়ালকে ভেকসিন দিতে গিয়ে জেসমিন কাউসার নামে এক গৃহিণী কর্তব্যরত চিকিৎসক কর্তৃক চিকিৎসা-অবহেলা, লাঞ্ছনা ও দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।

একুশে পত্রিকাকে তিনি বলেন, ১৫০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেও পেট ইউনিটে প্রায় ২ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি। পরে সাহেদ নামে একজন কর্মচারী এক নারী চিকিৎসককে ডেকে আমার বিড়ালটিকে দেখতে বলেন। গোলাপি এপ্রোন পড়া সেই মহিলা চিকিৎসকের হাবভাবে অবহেলা বুঝতে পেরে যত্নসহকারে চিকিৎসা দেওয়ার অনুরোধ করতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেন। বলেন, বেশি কথা বললে চিকিৎসা পাবেন না, চুপ থাকেন।

‘এর আগেও আমার একটি বিড়াল সিভাসু পেট ইউনিটের ভুল চিকিৎসার কারণে মারা গেছে। তাই এই অনুরোধটা করলাম ম্যাডাম আপনাকে’- একথা বলতেই বিড়ালটিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেই চিকিৎসক আমাকে বলেন, ‘আপনার ট্রিটমেন্টই করবো না! আপনার বিড়ালকে কে চিকিৎসা দেয় আমি দেখবো।’ যোগ করেন জেসমিন কাউসার।

তিনি বলেন, হাসপাতালের নিয়ম অনুসরণ করে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ১৫০ টাকা ও ভেকসিন বাবদ ১ হাজার টাকা দিয়েও শুধু সুচিকিৎসার অনুরোধ করায় আমাকে এভাবে লাঞ্চিত করা হলো।

২৫ মার্চ সরেজমিনে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) পেট ইউনিটে যেতেই চোখে পড়ে বেশ কিছু অসঙ্গতি। নিয়ম অনুযায়ী, যে চিকিৎসক পশুর চিকিৎসা দিয়েছেন প্রেসক্রিপশনে তার স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও তা থাকে না। অভিযোগকারীরা বলেন, চিকিৎসক না হয়েও অনেকে দিব্যি পশুর চিকিৎসা করছেন। যার কারণে ভুল চিকিৎসায় প্রিয় প্রাণীটির মৃত্যু হচ্ছে।

একুশে পত্রিকার হাতে আসা বেশ কয়েকটি প্রেসক্রিপশনে দেখা যায় ওষুধের নামসহ সিনিয়র ডাক্তারের কাছে রেফার করার বিষয়গুলো উল্লেখ থাকলেও চিকিৎসকের স্বাক্ষরের জায়গা খালি থাকতে দেখা গেছে। যিনি চিকিৎসা দিলেন তিনি আসলেই ডাক্তার কিনা তা বোঝার কোনো উপায়ই নেই।

শুধু তাই নয়, হাসপাতালের নিয়ম অনুসরণ করে প্রত্যেক প্রাণী চিকিৎসককে দেখানোর জন্য ১৫০ টাকার একটি টোকেন নিতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় রেজিস্ট্রেশন। আর রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়েই সেবাপ্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন সবচেয়ে বেশি।

এই রেজিস্ট্রেশনে কোনো সিরিয়াল মানতে দেখা যায়নি। রেজিস্ট্রেশন ফর্মে ‘কেইস রেজিস্ট্রেশন নাম্বার’ দেওয়া হলেও সেই সিরিয়াল অনুযায়ী সেবা দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও কোনো তদারকি করতে দেখা যায়নি। যার কারণে অনেকটা এলোমেলোভাবেই চিকিৎসা নিতে দেখা যায় সেবাপ্রার্থীদের।

এসময় ইসরাত জাহান ইমা নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ৭ তলা থেকে পড়ে পোষা বিড়াল আহত হওয়ায় চিকিৎসার জন্য এসেছেন তিনি। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন-জটিলতায় দুপুর ১২টা থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় আছেন। চিকিৎসা করা দূরের কথা, বার বার অনুরোধ করেও রেজিস্ট্রেশন করাতে পারেননি তিনি। আর রেজিস্ট্রেশন না করালে চিকিৎসা দেওয়া হবে না।

রেজিস্ট্রেশন-জটিলতার কারণ খুঁজতে রেজিস্ট্রেশন রুমে গেলে দেখা মিলে এক ব্যক্তির। রেজিস্ট্রেশন করানো যাবে কি?- এমন প্রশ্নে তিনি সাফ বললেন, একটা কাজ করছি। এখন রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার নিয়ম নেই। ১২টা বেজে গেছে ২ টার পর আসেন। অপারগতার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছু করার নাই। এটা সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি টিচিং হসপিটাল।’

কথোপকথনের এক পর্যায়ে প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিলে সুর পাল্টে ফেলেন সেই ব্যক্তি। এতোক্ষণ ধরে রেজিস্ট্রেশন করানো যাবে না বললেও হঠাৎ দাবি করেন, তিনি রেজিস্ট্রেশন সেক্টরে কাজ করেন না। নাম জানতে চাইলে বেপরোয়া ব্যবহার করার পাশাপাশি প্রতিবেদককে ধাক্কাও দেন তিনি। পরে হাসপাতালের অন্যান্য কর্মকর্তারা আসলে সেই ব্যক্তি উধাও হয়ে যান।

এদিকে, পশুর চিকিৎসা নিতে আসা বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী এক্স-রে করাতে ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন একুশে পত্রিকার কাছে।

চকবাজার এলাকার বাসিন্দা মো. রুবেল বলেন, অসুস্থ ছাগলের চিকিৎসার জন্য এসেছি। ডাক্তার এক্স-রে করিয়ে তারপর উনাকে সেই রিপোর্ট দেখাতে বলেছে। এক্স-রে করানোর জন্য ১০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছি সাড়ে ১১ টার দিকে। প্রায় ২ ঘণ্টা হতে চললো কিন্তু এখন এক্স-রে করাতে পারলাম না। আসলে এরা আমাদের গুরুত্ব দেয় না।

মো. মোর্শেদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমার কুকুরের পা ভেঙেছে। আজকে সাড়ে ১০ টার দিকে এসেছি। আসার পর ডা. ভজনের (ভেটেরিনারি ক্লিনিক পরিচালক) সাথে কথা বললাম। উনি বললেন এক্স-রে করাতে হবে। অন্য একজন ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। ১টার দিকে সেই ডাক্তার আসলেন। উনাকে বিষয়টি খুলে বললে ২টার পর যোগাযোগ করতে বলেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত (বিকেল ৪টা) অপেক্ষা করছি।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ছুটির দিন ছাড়া হাসপাতালটিতে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা প্রদানের কথা থাকলেও তা যথাযথ মানা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী।

তারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতাল চলাকালীন সময়ে ডাক্তার বা সংশ্লিষ্ট কেউই থাকেন না হাসপাতালে। কালক্ষেপণ ছাড়া কেউই ঠিকমতো সেবা নিতে পারছেন না বলেও জানান তারা।

শাহেদুল ইসলাম বলেন, গরুর বাছুর নিয়ে দুপুর ১টায় হাসপাতালে আসি। একজন বললো, ২টার আগে দেখানো যাবে না। কারণ ডাক্তার নাকি এখনো আসেননি। আমরা চিকিৎসার জন্য পশু নিয়ে আসছি, তাদের নিয়ম মেনে টাকাও দিচ্ছি। কিন্তু তারা যেভাবে পশুগুলোকে ফেলে রেখেছে তা নিঃসন্দেহে অবহেলা। এসময় নিজের পোষা প্রাণী নিয়ে চিকিৎসা নিতে অনেককে অপেক্ষা করতে দেখা গেলেও পুরো হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট কাউকেই দেখা যায়নি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি ক্লিনিকের পরিচালক ডা. ভজন চন্দ্র দাশ একুশে পত্রিকাকে বলেন, চিকিৎসা না দেওয়া ও খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে এসেছে সে আন্ডার গ্রেজুয়েট স্টুডেন্ট, ৪০১ ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী তবে তার নামটা আমার জানা নেই। কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে এর জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।’

তবে হাসপাতাল সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়ে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করলেও তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান এবং সরাসরি দেখা করে এসব বিষয়ে সমাধানের অনুরোধ জানান এই চিকিৎসক।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সেবাপ্রার্থীদের সাথে যদি খারাপ ব্যবহার করা হতো তাহলে তো এতো রোগী আসতো না। আমি এখানে নিজে থাকি, সব জানি। এরকম হাসপাতাল বাংলাদেশে নেই। তবে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে আমি এই বিষয়গুলো তদারকি করে দেখবো।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই হাসপাতালটি হলো টিচিং এন্ড ট্রেনিং হসপিটাল। আর করোনার সময় হওয়ায় আমাদের ইন্টার্ন ডাক্তার নেই, যেহেতু একাডেমি কার্যত্রমও চলছে না। আমি কয়েকজন ইন্টার্ন ডাক্তারকে অনুরোধ করে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে ডাক্তারের স্বল্পতার কারণে হয়তো সেবা নিতে এসে অনেকের অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’