মোহাম্মদ রফিক : দেশে ভোজ্য তেল নিয়ে রীতিমতো তেলেসমাতি চলছে। নতুন দামেও চট্টগ্রামের অনেক দোকানে ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ২০০ টাকায়। তেলের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, মিল মালিকরা কোনো ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) কিংবা এসও (সেলস অর্ডার) ইস্যু না করায় চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এখন তেল নেই বললেই চলে। ডিও ব্যবসায়ীদের কাছে তারা জিম্মি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মৌলভী বাজারেই চলছে মিল মালিক সিন্ডিকেটের ডিও বিক্রির ব্যবসা। কারসাজির পাশাপাশি নানা অজুহাতে গত আড়াই বছরে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বুকিং রেট বাড়ার কথা বললেও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) অভিযোগ, সরকার তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিল মালিকরা প্রতিনিয়ত ডিও’র মাধ্যমে ভোজ্যতেল তাদের নির্দিষ্ট ডিও ব্যবসায়ীদের মাঝে ছাড়ে। আর ডিও ব্যবসায়ীরা তা ভিন্ন ভিন্ন আকারে স্লিপের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদের তারিখে বাজারে বিক্রি করে দেয়। বলা যায়, ডিও ব্যবসায়ীরা মিল মালিকদের কাছে জিম্মি। আর স্লিপ মার্কেটের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা ডিও ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। দিনশেষে তাদের কাছে জিম্মি ভোক্তারা।
জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে খাতুনগঞ্জে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম মাত্র ৮৫ টাকা ছিল। তা আড়াই বছরের মাথায় এসে সরকার ১৯৮ টাকা দর নির্ধারণ করতে বাধ্য হয়েছে। গত ৫ মাসে লিটারে ৫০ টাকা বাড়তি হিসাবে ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের মেসার্স আর এন এন্ট্রারপ্রাইজের মালিক আলমগীর পারভেজ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বুকিং রেট প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। সে হিসেবে তেলের বাজার তো তিনগুণ বাড়েনি। বাজার দ্বিগুণের তুলনায় একটু বেশি বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে তিনগুণ। সে ক্ষেত্রে তো তেলের দাম বাড়বেই।’
এদিকে বাজারে তেল না থাকার অভিযোগ করে ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল পর্যায়ে খোলা তেল দিচ্ছে। কিন্তু বোতলজাত তেল দিচ্ছে না। কোম্পানিগুলো আগে থেকেই ডিও নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে ক্যাবের অভিযোগ, ২০২০ সালের শুরুতে তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাত ছিল করোনার প্রভাব। এখন অজুহাত দেখানো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কারসাজি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মৌলভীবাজারে ভোজ্যতেল নিয়ে অবৈধ ডিও ব্যবসা চলে আসছে বছরের পর বছর। প্রশাসনও এদের কাছে জিম্মি। কেননা, বাজারে অভিযান চালালেই এরা পণ্যের বেচাকেনা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে ভোক্তা অধিদফতর যে অভিযান চালাচ্ছে তা অনেকটা পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে। জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু ডিও ও স্লিপ ব্যবসায়ীরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। অর্থাৎ রাঘববোয়ালরা বহাল তবিয়তে থাকছে। চুনোপুঁটিরা খেসারত দিচ্ছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৮৫ হাজার টন। আর প্রায় ২৪ লাখ টন সয়াবিন বীজ থেকে পাওয়া যায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার টন তেল। এর মধ্যে পরিশোধন ও খালাসের সময় অপচয় বাদ দিলে প্রায় ১২ লাখ টন সয়াবিন আমদানি ধরা যায়। গড়ে প্রতিমাসে ১ লাখ টন চাহিদা দেশে। সয়াবিন তেল আমদানি হয়ে থাকে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশে মোট ছয়টি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত আকারে সয়াবিন এনে তা পরিশোধন করে বাজারজাত করে।
এ মাসের শুরুতে ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় রান্নায় ব্যবহৃত সয়াবিন তেল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সায় নিয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করেন মিল মালিকরা। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বাড়তি লাভের জন্য ব্যবসায়ীরা ১০ দিনে ৪০ হাজার টনের মতো সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুদ করেছেন ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ধারণা।
৫ মে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ৩৮ টাকা, খোলা ৪০ টাকা ও পাম তেলে ৪২ টাকা বাড়িয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবু দেশজুড়ে ভোজ্যতেলের সংকট। তবে উল্টো চিত্র দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের। ঈদের আগে যে খোলা সয়াবিন তেল মণপ্রতি সাড়ে সাত হাজার টাকা ছিল, তা আজ বুধবার (১১ মে) বিক্রি হয়েছে সাত হাজার দুইশ টাকায়। একইভাবে পাম তেল ছয় হাজার পাঁচশ টাকা বিক্রি করা হলেও সোমবার বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার দুইশ টাকায়।
জানা গেছে, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে চাহিদার এক তৃতীয়াংশ বেশি ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের গত ৮ মে পর্যন্ত (বছরের প্রথম ১০ মাস ৮ দিনে) ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৩৫৮ মেট্রিক টন তেল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাম তেল ১৯ লাখ ২ হাজার ৫১০ টন ও সয়াবিন তেল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৮৪৮ টন।
১৫ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৫৪ দিনে আমদানি হয়েছে চার লাখ ৯১ হাজার ৩০৩ মেট্রিক টন তেল। এর মধ্যে পাম তেল তিন লাখ ১৬ হাজার ৬৪৩ মেট্রিক টন। সয়াবিন তেল এক লাখ ৭৪ হাজার ৬৬০ মেট্রিক টন। এখনো অর্ধেকের বেশি বন্ডেন্ড ট্যাংক থেকে খালাস নেননি মিলাররা। নতুন দর অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন তেল লিটার প্রতি ১৪০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটার প্রতি ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়েছে। ৫ লিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৯৮৫ টাকা। তাছাড়া পরিশোধিত পাম সুপার তেল ১৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭২ টাকা করা হয়েছে।
একজন ডিও ব্যবসায়ী একুশে পত্রিকাকে বলেন, দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপ খাতুনগঞ্জের বাজারে অসংখ্য ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) ছেড়েছে। যা বাজারের সক্ষমতার বেশি। ডিও ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, ‘বাজারে ঈদের আগে পাম তেল প্রতিমণ সাড়ে ছয় হাজার ছাড়িয়েছিল। কিন্তু গত সোমবার সেই পাম তেল ছয় হাজার দুইশ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। আজ বুধবার বাজারে এস আলমের পাম তেল প্রতিমণ ছয় হাজার চারশ টাকা হলেও ঢাকার সিটি গ্রুপের ডিও বিক্রি হয়েছে ছয় হাজার ৬০০ টাকার বেশিতে।’
সরকারী তথ্যমতে, দেশে বছরে সয়াবিন তেলের চাহিদা ১২ লাখ টনের বেশি। এই চাহিদার ১২ লাখ টনই পূরণ হয় অপরিশোধিত আকারে সয়াবিন আমদানি করে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৮৫ হাজার টন। আর প্রায় ২৪ লাখ টন সয়াবিন বীজ থেকে পাওয়া যায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার টন তেল। এর মধ্যে পরিশোধন ও খালাসের সময় অপচয় বাদ দিলে প্রায় ১২ লাখ টন সয়াবিন আমদানি ধরা যায়। গড়ে প্রতিমাসে ১ লাখ টন চাহিদা দেশে। সয়াবিন তেল আমদানি হয়ে থাকে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে। দেশে মোট ছয়টি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত আকারে সয়াবিন এনে তা পরিশোধন করে বাজারজাত করে।
জানা গেছে, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, ঢাকার মৌলভী বাজার এসব জায়গায় সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপের হাজার হাজার ডিও মার্কেটে ছাড়া আছে। এসব ডিও তারা মার্কেটে বিক্রি করেছে। কিন্তু এসব তেল মিল থেকে উত্তোলন না করার কারণে তেলগুলো মিলে স্টক থাকে। ক্যাব জানায়, সরকার যদি একটা ডিও’র মেয়াদ সর্বোচ্চ ১৫ দিন করে দেয় তাহলে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখা দেবে না। তেলের মূল্য কমে আসবে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বাদশা মার্কেটের আলম টেডিং, সাব্বির ট্রেডিং, জাহেদ এন্ড ব্রাদাস, এ এম ট্রেডিং, আর এন ট্রেডিং খাতুনগঞ্জ সোনামিয়া মার্কেটের আর এস ট্রেডিং, এম হুসেন ব্রাদার্স, আহাদ ট্রেডিং, দীন এন্ড কোম্পানি, মীর গ্রুপের হুসাইন ব্রাদার্স ও সালাম এন্ড সন্স, খালেক ব্রাদার্স, এশিয়া মার্কেটের এম-এল ট্রেডিং, মুক্তা মার্কেটের এম কে ট্রেডিং বাদশা মার্কেটের কে এম ট্রেডিং, এল এফ ট্রেডিং, চাক্তাই এলাকার নিশাত এন্টার প্রাইজ, মুসা এন্ড সন্সসহ এরকম আরও শত শত প্রতিষ্ঠান ডিও ব্যবসায় জড়িত।
আহমদ আলী নামে একজন ভোক্তা বলেন, ‘খুচরা দোকানে অভিযানে না গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ে থাকা ডিও যদি সর্বোচ্চ ১৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারি না নেয় তাহলে সরকার এসব ডিও বা মাল বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিলে দুই দিনেই তেলের দাম কমতে বাধ্য। সরকারকে মিলের উপর তদারকি রাখতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিল মালিকরা উৎপাদন কত করছে ও স্টকে কত লিটার আছে সেটাও হিসাবে নিতে হবে। সরকার এখান থেকে কত ভ্যাট পাচ্ছে সেটাও বেরিয়ে আসবে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর গত চার মাসের ব্যাংক হিসাব চেক করলে বুঝা যাবে তারা কত টাকা মানুষকে জিম্মি করে আয় করেছে।
ক্যাবের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজারে ২০০ ডলার পর্যন্ত তেলের দাম কমেছে। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে, সে সময়ে আমাদের দেশে তেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, এখানে মিল মালিক, আমদানিকারক, ডিলার, রিফাইনার এবং খুচরা ব্যবসায়ী- যে যেখানে পেরেছে সেখানে কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেকে তেল মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন।’