বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সরকারের পদক্ষেপ: কতটা সফল হবে?

প্রকাশিতঃ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন


একুশে প্রতিবেদক : সম্প্রতি দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অর্থ পাচার রোধে এবং পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সফরের সময় উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সহযোগিতা কামনা করেন। অর্থনীতিবিদরা সরকারের এ পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি ভবিষ্যতে অর্থ পাচার বন্ধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ সময়ে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যার প্রধান গন্তব্য ছিল যুক্তরাজ্য, দুবাই, সিঙ্গাপুর, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র। পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশ বাণিজ্যের আড়ালে হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)-এর তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এটি বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। গড়ে প্রতি বছর অন্তত এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি পাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাচার রোধে কাঠামোগত পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাচার রোধ ও পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারে সরকার ইতিমধ্যে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে সভাপতি করে গঠিত ৯ সদস্যের এই টাস্কফোর্স পাচারকৃত সম্পদ চিহ্নিতকরণ, তদন্ত ও পুনরুদ্ধারের দায়িত্বে কাজ করবে। টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি হিসেবে পাচারকৃত সম্পদ শনাক্ত ও তদন্তে সহযোগিতা, মামলার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়, এবং পাচারকৃত অর্থের ব্যবস্থাপনা ও দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. জাকির হোসেন চৌধুরী টাস্কফোর্সের কার্যক্রম সমন্বয় করবেন এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) টাস্কফোর্সকে প্রয়োজনীয় সাচিবিক সহায়তা প্রদান করবে।

টাস্কফোর্সের পাশাপাশি, সরকার পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) এফবিআই-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে, যেখানে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ভবিষ্যতে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকও এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) সঙ্গে বৈঠকে দেশের বাইরে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন চুক্তি করতে হতে পারে। পাচার হওয়া অর্থ সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে বলেই এটি উদ্ধার করা আরও সময়সাপেক্ষ হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য পাচারের পথগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে যাতে অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়।

অর্থ পাচার রোধে সরকার ২০১৫-১৯ এবং ২০১৯-২১ সময়কালের জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কৌশলপত্র তৈরি করেছিল, যার নাম ছিল ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যান্ড কমব্যাটিং ফাইন্যান্স অব টেররিজম’। কিন্তু ২০২১ সালের পর আর কোনো নতুন কৌশলপত্র তৈরি হয়নি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এই ধরনের কৌশলপত্র প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা উচিত। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হওয়া শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ক্যামেন আইল্যান্ড এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড।

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএফ) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি অর্থ পাচার বন্ধে মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধার জটিল ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া হতে পারে, তাই পাচারের চ্যানেলগুলো বন্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় ও উদ্যোগে এই কাজ সম্ভব হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ফলে পাচার রোধ ও অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও টাস্কফোর্সের কার্যক্রমের মাধ্যমে পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা সঠিক পথে এগোচ্ছে। তবে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও চুক্তির মাধ্যমে এ প্রচেষ্টাকে বেগবান করতে হবে।