সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কর্ণফুলী টানেল: বিলাসবহুল অতিথিশালায় লোকসানের হাহাকার!

| প্রকাশিতঃ ২৩ নভেম্বর ২০২৪ | ১:০০ অপরাহ্ন


চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পটি দেশের প্রথম নদীর তলদেশীয় টানেল হিসেবে পরিচিত। তবে প্রকল্পের কিছু সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, টানেলের আওতায় নির্মিত বিলাসবহুল অতিথিশালা এখন পর্যন্ত ব্যবহার হয়নি এবং পুরো প্রকল্পটি বিশাল আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছে।

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে চালু হয়। প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম নগরকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কক্সবাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করা। প্রাথমিক পরিকল্পনায় এটি চট্টগ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে টানেলের ব্যবহার প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। টানেলটি দিয়ে বর্তমানে দৈনিক গড়ে সাড়ে তিন হাজার যানবাহন চলাচল করছে। অথচ প্রকল্পের সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে, টানেল চালু হলে দিনে ২০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করবে। যানবাহনের সংখ্যা কম থাকায় টোল আদায়ের আয়ও কম।

টানেলের মাসিক আয় মাত্র আড়াই কোটি টাকা, যেখানে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। এর ফলে মাসিক গড়ে প্রায় ৯ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে।

টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে, আনোয়ারার পারকি খালের পাশে তৈরি করা হয়েছে একটি বিলাসবহুল অতিথিশালা। অতিথিশালাটি আধুনিক মানের এবং সাত তারকা পর্যায়ের হিসেবে বিবেচিত। প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের বাংলোতে ছয়টি বিলাসবহুল কক্ষ, সুইমিং পুল, এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য রয়েছে।

অতিথিশালা ছাড়াও সেখানে নির্মিত হয়েছে ৩০টি রেস্টহাউস, একটি সম্মেলনকেন্দ্র, একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পুলিশ ও ফায়ার স্টেশন, মসজিদ, এবং বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে একটি জাদুঘর। সার্ভিস এরিয়ায় ৭২ একর জমি জুড়ে এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।

অতিথিশালা তৈরির পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। প্রকল্প কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, প্রধানমন্ত্রী সফরে গেলে তিনি এখানে অবস্থান করবেন। তবে বাস্তবে অতিথিশালাটি কোনো কাজে আসেনি।

প্রকল্পের শুরুতে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। কিন্তু বিভিন্ন ধাপে ব্যয় বাড়িয়ে তা ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে অতিথিশালা ও অন্যান্য বিলাসবহুল স্থাপনা যুক্ত করার ফলে ব্যয় আরও বেড়ে যায়।

অতিথিশালা নির্মাণে সাড়ে চার শ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তবে এটি এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। সেতু বিভাগ বলছে, অতিথিশালা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই। অথচ এই স্থাপনাগুলো তৈরির যৌক্তিকতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ধরনের স্থাপনা প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ছিল না। চট্টগ্রামের পারকি সৈকতে ইতোমধ্যে পর্যটন করপোরেশনের অধীনে একটি আধুনিক পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুবিধা থাকছে। ফলে একই এলাকায় বিলাসবহুল অতিথিশালা তৈরির কোনো যুক্তি নেই।

প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাগত ত্রুটি রয়েছে। টানেল চালু হওয়ার আগে ধারণা করা হয়েছিল যে এটি চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানের যাতায়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু টানেল দিয়ে যান চলাচল কম হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

১. টোল ফি বেশি: শাহ আমানত সেতুতে টোল মাত্র ৫০ টাকা, যেখানে টানেলের টোল ৩০০ টাকা। ফলে অধিকাংশ যানবাহন এখনো শাহ আমানত সেতু ব্যবহার করছে।

২. সংযোগ সড়ক সরু ও অপর্যাপ্ত: আনোয়ারা থেকে চন্দনাইশ পর্যন্ত সড়কটি সরু এবং তা টানেল থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যুক্ত হয়নি। ফলে টানেল ব্যবহারে অনীহা দেখা যাচ্ছে।

৩. সঠিক পরিকল্পনার অভাব: টানেলের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিকল্পনা করা হয়নি। শিল্পায়ন ও আবাসন প্রকল্প না থাকায় দক্ষিণ চট্টগ্রামে যান চলাচল বাড়েনি।

বর্তমান উদ্যোগ ও সমাধান প্রস্তাব

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় টানেলের ব্যবহার বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
– চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানগামী বাসগুলো টানেল ব্যবহার করবে, এমন পরিকল্পনা।
– আনোয়ারা থেকে চন্দনাইশ পর্যন্ত সরু সড়ক সম্প্রসারণের নির্দেশ।
– আনোয়ারায় শিল্পায়ন ও আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ।
– মাতারবাড়ী জ্বালানি কেন্দ্রের সঙ্গে টানেল সংযোগ স্থাপন।

এছাড়া অতিথিশালাটি বেসরকারি খাতে পরিচালনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বেসরকারি খাতে পরিচালিত হলে অতিথিশালাটি কিছুটা আয় করতে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মনে করেন, টানেল প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় এবং অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণের কারণে বিশাল অর্থ অপচয় হয়েছে। তিনি বলেন, “টানেলটি আগামী পাঁচ থেকে সাত বছর পূর্ণ ব্যবহার হবে না। অথচ বিপুল ব্যয়ে অতিথিশালা তৈরি করা হয়েছে, যা টানেলের মূল কাজে কোনো সহায়তা করে না। প্রকল্পের অর্থ লুটপাটের জন্য এসব অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।”

পর্যটন কমপ্লেক্সের ভূমিকা

পারকি সৈকতের পাশে পর্যটন করপোরেশন ১৩ একর জমিতে ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে। সেখানে থাকবে ১০টি একক কটেজ, চারটি ডুপ্লেক্স কটেজ, এবং একটি বহুমুখী ব্যবহার ভবন। এছাড়া হ্রদ, শিশুদের খেলার জায়গা, এবং অন্যান্য সুবিধা থাকবে। পর্যটন কমপ্লেক্সটি টানেলের মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যটন কমপ্লেক্স যথেষ্ট হওয়ায় বিলাসবহুল অতিথিশালার প্রয়োজন ছিল না।