
দেশের অর্থনীতির সিংহভাগই চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীল। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হয় এই বন্দরের মাধ্যমে। তাই একে জাতীয় অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ বললে অত্যুক্তি হয় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্দরের আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, জেটি সংস্কার করা হয়েছে, অনলাইন গেট পাস সিস্টেম চালু হয়েছে। এসবই বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু এত কিছুর পরেও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, যা বন্দরের কর্মদক্ষতা ও নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
সম্প্রতি অনলাইন গেট পাস সিস্টেম চালু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি বড় বাধা দূর করেছে। এতে বন্দরে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় বাঁচবে, কমবে যানজট। কিন্তু আরও চারটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যেগুলো দ্রুত সমাধান করা না গেলে বন্দরের সার্বিক উন্নতি ব্যাহত হবে।
প্রথমত, বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাসের পুরনো পদ্ধতি। বিশ্বের আধুনিক বন্দরগুলোতে বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাসের কোনো সুযোগ নেই। সেখানে আমদানি করা সব পণ্য বন্দরের বাইরে আমদানিকারকের নিজস্ব জায়গায় অথবা বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে (অফডক) খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে এখনও বেশিরভাগ পণ্য বন্দরের ভেতরেই খালাস হয়। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও শ্রমিক বন্দরে প্রবেশ করে। ফলে একদিকে যেমন বন্দরের ভেতরে যানজট ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, তেমনি নিরাপত্তা ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, বন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা। বন্দরের ভেতরে অবাধে মানুষের প্রবেশাধিকার থাকায় ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য, মাদক, এমনকি অস্ত্র আসার ঘটনাও ঘটছে। বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (আইএসপিএস কোড) বাইরের লোকের প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তৃতীয়ত, স্ক্যানার বসানোর দীর্ঘসূত্রতা। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ঠেকাতে এবং নিরাপত্তা জোরদার করতে চীন থেকে চারটি কনটেইনার স্ক্যানার আনা হয়েছিল প্রায় দেড় বছর আগে। কিন্তু সেগুলো এখনও বসানো যায়নি। বন্দরের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় স্ক্যানার বসানোর ক্ষেত্রে এমন দীর্ঘসূত্রতা গ্রহণযোগ্য নয়।
চতুর্থত, বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলোর (আইসিডি) সক্ষমতা। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, বন্দরের ওপর চাপ কমাতে হলে আমদানি করা পণ্যের খালাস বন্দরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বেসরকারি আইসিডিগুলোর সক্ষমতা ও দক্ষতা নিয়ে ব্যবসায়ী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অধিকাংশ আইসিডিতে পর্যাপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল নেই। ফলে পণ্য খালাসে সময় বেশি লাগে, খরচও বাড়ে। অন্যদিকে, এনবিআর মনে করে, আইসিডিগুলোর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই টানাপোড়েনের কারণে বন্দরের আধুনিকায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বন্দরের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থের কনটেইনারগুলো নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। এসব কনটেইনার থেকে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দরের উন্নতির জন্য তারা সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন গেট পাস সিস্টেম তারই প্রমাণ। বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব জানিয়েছেন, বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাসের সমস্যা সমাধানে তাঁরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়েছেন। বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোর (অফডক) সক্ষমতা বাড়ানোর জন্যও বলা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর আপত্তির কারণে এনবিআর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
সমস্যা সমাধানে বন্দর কর্তৃপক্ষ, এনবিআর, ব্যবসায়ী সংগঠন এবং অন্যান্য অংশীদারদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখানে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হলো:
১. বন্দরের ভেতরে পণ্য খালাস বন্ধ: যত দ্রুত সম্ভব বন্দরের ভেতরে সব ধরনের পণ্য খালাস বন্ধ করতে হবে। আমদানি করা সব পণ্য বন্দরের বাইরে খালাস করতে হবে।
২. অফডকের সংখ্যা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি: বন্দরের বাইরে আরও বেশি সংখ্যক অফডক গড়ে তুলতে হবে এবং সেগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে। অফডকগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে হবে।
৩. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি: অফডকগুলোর সেবার মান ও খরচের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ থাকলে সেগুলো দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. স্ক্যানার স্থাপন: আমদানি করা স্ক্যানারগুলো দ্রুত বসানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে আরও আধুনিক স্ক্যানার আমদানি করতে হবে।
৫. নিরাপত্তা জোরদার: বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। বহিরাগতদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৬. ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক অপসারণ: বন্দরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থের কনটেইনারগুলো দ্রুত সরিয়ে নিতে হবে।
৭. সমন্বিত উদ্যোগ: বন্দর কর্তৃপক্ষ, এনবিআর, ব্যবসায়ী সংগঠন এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি আধুনিক, নিরাপদ ও গতিশীল বন্দরে পরিণত করা সম্ভব।
চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি বন্দর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। একে সচল ও নিরাপদ রাখা জাতীয় স্বার্থেই জরুরি।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।