
গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে একসময়ের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এখন কার্যত মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে। বিএনপি সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো গণভোট হতে দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে জামায়াত নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবিতে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছে। এই অচলাবস্থার মধ্যেই জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, তারা আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো আনুষ্ঠানিক ‘জোট’ গঠন করছেন না, বরং সমমনা দল ও ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘আসনভিত্তিক সমঝোতা’র ভিত্তিতে এগোবেন।
গত কয়েকদিন ধরেই গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা তির্যক ভাষায় পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন। বৃহস্পতিবার যশোর টাউন হল মাঠে এক স্মরণসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতের নাম উল্লেখ না করে কড়া সমালোচনা করেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, “কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে। নির্বাচন বানচালের চেষ্টাও করছে। এমনকি তারা নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়। কিন্তু জনগণ তা কখনো মেনে নেবে না।”
বিএনপির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, “১৭ অক্টোবর সংস্কার নিয়ে আমরা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে সনদে সই করেছি, সেসব বিষয় সামনে রেখে আমাদের পথ চলতে হবে। ৮৩ কোটি টাকা খরচ করে ঐকমত্য কমিশন শুধু মিটিং আর খাওয়া-দাওয়াই করল। আর এখন সরকার বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিন সময় দেওয়া হলো, মতবিরোধ নিরসন করতে। বিএনপিকে কি আপনাদের খেলনা মনে হয়? মনে রাখবেন, বিএনপি ভেসে আসা দল নয়।”
অন্যদিকে জামায়াতের নেতারা বলছেন, বিএনপি প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে চায় না এবং ক্ষমতায় গেলে জুলাই সনদের অনেক বিষয় বাস্তবায়ন করবে না। এ কারণেই জামায়াত সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট এবং ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়াই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি বাস্তবায়নে মরিয়া। এই দাবির সপক্ষে জামায়াত ইতোমধ্যে সমমনা আরও সাতটি দলকে যুক্ত করেছে।
বৃহস্পতিবার এই আট দলের পক্ষ থেকে পল্টন থেকে মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। সেখানে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, দাবি আদায়ে “সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করব।” পরে মৎস্য ভবন মোড়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “জামায়াতসহ যে ৮টি দল পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে তা ১১ নভেম্বরের আগে সরকারকে মেনে নিতে হবে। তা না হলে দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ হবে এবং ওইদিন ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জুলাই বিপ্লবের পক্ষে থাকা দলগুলোর এই বিরোধ দ্রুত মেটানো না গেলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে এবং নির্বাচন নিয়ে ফের সংশয় দেখা দিতে পারে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি ও জামায়াতের এই মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ‘বিব্রত’ এবং বিরোধ মেটাতে পর্দার আড়ালে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে চারজন উপদেষ্টা ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে দুই দফা কথা বলেছেন, তবে এখন পর্যন্ত সমঝোতার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।
এই রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যেই বুধবার সিলেটে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান জোট না করার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “আমরা কোনো জোট করছি না। নির্বাচনি সমঝোতার ভিত্তিতে এগোব। প্রতিটি জায়গায় একটি বাক্স থাকবে এই নীতিতেই আমরা কাজ করছি।”
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, “আমরা প্রচলিত কাঠামোগত জোট করছি না। সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বসে নিশ্চিত করব- যেন একই আসনে একাধিক প্রার্থী না থাকে।”
সমমনা একটি ইসলামী দলের সূত্র জানিয়েছে, জোট না হওয়ার অন্যতম কারণ শরিয়াহ আইন চালুর বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত মতপার্থক্য। জামায়াত মনে করে এটি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে, যেখানে অন্যান্য দল কিছুটা কট্টর অবস্থানে। এছাড়া, আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে অধিক সংখ্যক দলের অংশগ্রহণ দেখিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ হিসেবে তুলে ধরাও এই সমঝোতা কৌশলের একটি কারণ হতে পারে। সংশোধিত আরপিও অনুসারে জোটবদ্ধ হলেও প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে, যা আসনভিত্তিক সমঝোতাকে সহজ করে তুলেছে।