ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনাপ্রবাহের সূচনা হয়েছিল হিজরি দশম সনের জিলকদ মাসে। মদিনার পবিত্র ভূমি থেকে এক ঐশী আহ্বান ধ্বনিত হলো – রাহমাতুল্লিল আলামিন, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্বে যাবেন। এই ঘোষণা বাতাসের আগে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ল আরবের প্রতিটি প্রান্তে। দূর-দূরান্ত থেকে, গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে, অগণিত সাহাবি রাসূল (সা.) এর ডাকে সাড়া দিয়ে মদিনার পানে ছুটতে শুরু করলেন। তাঁদের হৃদয়ে ছিল অজানা এক স্পন্দন, এক মিশ্র অনুভূতি – একদিকে যেমন ছিল প্রিয় নবীজির সান্নিধ্যে হজ্ব পালনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে এক অব্যাক্ত শঙ্কাও কাজ করছিল। সবার মনে হচ্ছিল, এই আহ্বানের মাঝে হয়তো লুকিয়ে আছে বিশেষ কোনো তাৎপর্য। হতে পারে এটাই নবীজির (সা.) সাথে তাঁদের শেষ দীর্ঘ সফর, জীবনের শেষ পাঠ গ্রহণ, কিংবা হয়তো এক মহিমান্বিত বিদায়ের পূর্বাভাস।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সমগ্র নবুওয়তি জীবনে মাত্র একবারই হজ্বব্রত পালন করেছিলেন। ইতিহাসের পাতায় এটিই ‘হজ্জাতুল বিদা’ বা বিদায় হজ্ব নামে পরিচিত। এই হজ্ব কেবল একটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ছিল না, বরং এটি ছিল নবুওয়তের পূর্ণাঙ্গতার ঘোষণা, ইসলামের বিশ্বজনীন বার্তার সারসংক্ষেপ এবং মানবজাতির জন্য মুক্তির এক কালজয়ী সনদ। এখান থেকেই বিশ্ববাসী পেয়েছিল সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও নারী অধিকারের এক বিপ্লবী দিকনির্দেশনা।
মদিনা থেকে যখন হজ্বের কাফেলা রওনা হলো, তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। প্রায় এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার (বিভিন্ন বর্ণনায় সংখ্যায় তারতম্য রয়েছে) পুণ্যবান সাহাবির এক বিশাল জনসমুদ্র নবীজিকে (সা.) কেন্দ্র করে এগিয়ে চলছিলেন। তাঁদের মুখে ছিল ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনি, হৃদয়ে ছিল আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য আর চোখে ছিল নবীজির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। এই সফরের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিক্ষণীয়। নবীজি (সা.) অত্যন্ত যত্ন সহকারে সাহাবিদের হজ্বের নিয়মকানুন, যেমন – কীভাবে তাওয়াফ করতে হয়, কীভাবে সাফা-মারওয়া সায়ী করতে হয়, কুরবানি দেওয়ার নিয়ম এবং নামাজের পদ্ধতি হাতে-কলমে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আরাফাত, মুজদালিফা, মিনা – হজ্বের প্রতিটি স্থানে তাঁর নির্দেশনায় পালিত হচ্ছিল যাবতীয় কার্যক্রম। সবকিছুতেই ফুটে উঠছিল ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ও শৃঙ্খলার এক অসাধারণ চিত্র।
অতঃপর এলো সেই ঐতিহাসিক দিন – ৯ জিলহজ, আরাফার দিন। সূর্য তখন মধ্যগগনে, তার প্রখরতা বাড়িয়ে চলেছে। আরাফাতের সুবিশাল ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ নবীপ্রেমিক সাহাবিদের উপস্থিতিতে। লক্ষ লক্ষ মানুষের এই মহাসমাবেশে বিরাজ করছিল এক অভাবনীয় নীরবতা ও গাম্ভীর্য। নবীজি (সা.) তাঁর কাসওয়া নামক উষ্ট্রীতে আরোহণ করে ময়দানের এক উঁচু স্থানে দাঁড়ালেন এবং বিশ্বমানবতার উদ্দেশে পেশ করলেন তাঁর সেই কালজয়ী ভাষণ, যা ‘বিদায় হজ্বের খুতবা’ নামে পরিচিত।
তাঁর প্রতিটি শব্দ ছিল আলোকবর্তিকার মতো, প্রতিটি বাক্য ছিল মানবমুক্তির এক পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ। এই ভাষণে তিনি সর্বপ্রথম আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দিলেন এবং মানুষকে কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানালেন। তিনি বললেন, “হে মানব সকল! মনোযোগ দিয়ে শোনো, আমার কথাগুলো। হয়তো আমি আর কখনো তোমাদের সাথে এভাবে একত্রিত হতে পারবো না।” এই বাক্য উপস্থিত জনতার হৃদয়ে এক বিদায়ের সুর বাজিয়ে দিয়েছিল।
তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “হে মানুষ! তোমাদের প্রভু এক, তোমাদের পিতা আদমও এক। জেনে রেখো, কোনো আরবের উপর অনারবের, কোনো অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি কোনো শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কোনো মর্যাদা নেই। মর্যাদার একমাত্র মাপকাঠি হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি।” বর্ণবাদ ও জাতিগত অহংকারের মূলে কুঠারাঘাত করে তিনি বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন।
নবীজি (সা.) মানুষের জান ও মালের পবিত্রতা ঘোষণা করে বললেন, “তোমাদের একের রক্ত ও সম্পদ অপরের জন্য তেমন হারাম (সম্মানিত), যেমন আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহর তোমাদের জন্য হারাম (সম্মানিত)।” তিনি আমানতদারিতার উপর গুরুত্বারোপ করে বললেন, “যার কাছে কোনো আমানত রাখা হয়, সে যেন তা তার মালিকের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দেয়।”
অন্ধকার যুগের এক ভয়াবহ শোষণ, সুদ প্রথাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করলেন। তিনি বললেন, “জাহিলি যুগের সমস্ত সুদ আজ থেকে বাতিল করা হলো। আমি সর্বপ্রথম আমার চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের প্রাপ্য সুদ বাতিল করে দিলাম।” এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক শোষণের পথ রুদ্ধ করে এক ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শন করলেন।
এরপর তিনি উচ্চারণ করলেন ইতিহাসের সেই যুগান্তকারী বাক্যমালা, যা নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক মাইলফলক। তিনি বললেন, “হে লোকসকল! নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা আল্লাহর নামে তাদের গ্রহণ করেছো এবং আল্লাহর কালামের মাধ্যমে তাদের তোমাদের জন্য হালাল করে নিয়েছো। তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তোমাদের উপরও তাদের তেমন অধিকার রয়েছে। তাদের প্রতি সদয় আচরণ করবে।” এমন এক সময়ে তিনি এই ঘোষণা দেন, যখন বিশ্বের বহু প্রান্তে নারীদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হতো না, তাদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। নবীজির (সা.) এই বক্তব্য ছিল নারীমুক্তির এক আশ্চর্য বিপ্লব, তাদের সম্মানের পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা।
তিনি দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতার কথা উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়িদা, আয়াত ৩)
ভাষণের শেষে তিনি সমবেত জনতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দিয়েছি?” লক্ষ কণ্ঠ একসঙ্গে ধ্বনিত করে উঠলো, “জি হ্যাঁ, অবশ্যই পৌঁছে দিয়েছেন।” তখন তিনি আকাশের দিকে শাহাদাত আঙুল তুলে তিনবার বললেন, “আল্লাহুম্মাশহাদ… আল্লাহুম্মাশহাদ… আল্লাহুম্মাশহাদ।” অর্থাৎ, “হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো… হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো… হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।” সেই মুহূর্তে সমগ্র আরাফাত ময়দান জুড়ে নেমে এসেছিল এক অপার্থিব নীরবতা। আকাশ-বাতাস যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ যেন ছিল এক মহিমান্বিত বিদায়ের চূড়ান্ত মুহূর্ত।
এই ঐতিহাসিক হজ্বের মাত্র ৮১ দিন পর, হিজরি ১১ সনের ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার এক শুভ্র সকালে, এই মহান পথপ্রদর্শক, মানবতার মুক্তির দূত, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহলোক ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন।
কিন্তু তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক পূর্ণাঙ্গ দ্বীন, এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান – আল-কুরআন এবং তাঁর সুন্নাহ বা জীবনাদর্শ। তিনি বলে গেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা এ দুটিকে আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না – আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং আমার সুন্নাহ।”
আজও যখন সৌভাগ্যবান হাজিগণ হজ্ব পালন করতে যান, আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন, কিংবা কাবার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখন তাঁদের হৃদয়ে যেন সেই একই কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয় – “তোমরা পরস্পরের জান-মাল-ইজ্জতের ব্যাপারে সতর্ক থেকো… নারীদের সম্মান করো… কাউকে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠ ভেবো না… আমি যা রেখে যাচ্ছি, তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো…”
বস্তুত, বিদায় হজ্ব কোনো বিদায় ছিল না। এটি ছিল মানবজাতির জন্য অনন্তকাল ধরে পথ চলার এক সুস্পষ্ট নির্দেশিকা, ভালোবাসার এক গভীর পাঠ এবং মুক্তির এক চিরন্তন পয়গাম। এই হজ্বের ভাষণ শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য শান্তি, সম্প্রীতি ও কল্যাণের পথ বাতলে দেয়।
আসুন, আমরা সেই প্রেম, সেই শিক্ষা, সেই কালজয়ী আদর্শকে কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজেদের জীবনে, পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে ধারণ করি। নবীজির (সা.) দেখানো পথে চলে এক সুন্দর ও ন্যায়ভিত্তিক পৃথিবী গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাই। তবেই বিদায় হজ্বের প্রকৃত তাৎপর্য বাস্তবায়িত হবে।
লেখক : লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল-এর সাবেক মাল্টিপল ডিস্ট্রিক্ট ট্রেজারার। বর্তমানে লায়ন্স ক্লাবস ইন্টারন্যাশনাল-এর আরসি (রিজিয়ন চেয়ারপার্সন), হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।