মুসলিম উম্মাহর জীবনে আত্মত্যাগ, উৎসর্গ এবং আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের এক মহিমান্বিত বার্তা বহন করে নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রতি বছর আরবি জিলহজ মাসের দশম দিনে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা এই উৎসব পালন করেন। এটি কেবল পশু কোরবানির একটি আনুষ্ঠানিক পর্ব নয়, বরং এর প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে মানব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা, যা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার এক চূড়ান্ত নিদর্শনের স্মৃতি বহন করে। ঈদুল আজহার মূল ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে আল্লাহর অকৃত্রিম বন্ধু (খলিলুল্লাহ) হযরত ইবরাহিম (আ.), তাঁর পরম অনুগত পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.) এবং তাঁর মহীয়সী স্ত্রী হযরত হাজেরা (আ.)-এর জীবনের বিভিন্ন ঈমানদীপ্ত পরীক্ষা ও সেগুলোতে তাঁদের অবিচল থাকার ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে।
মানব ইতিহাসের এক ঊষালগ্নে, যখন পৃথিবী শিরক, পৌত্তলিকতা ও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, তখন আলোর মশাল নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন হযরত ইবরাহিম (আ.)। তিনি এমন এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে মানুষ এক আল্লাহকে ভুলে নিজেদের হাতে গড়া মূর্তির উপাসনা করত। তাঁর পিতা আজর নিজেই ছিলেন সেই সময়ের একজন প্রধান মূর্তি নির্মাতা ও প্রচারক। কিন্তু শিশুকাল থেকেই হযরত ইবরাহিম (আ.) এক অদ্বিতীয় সত্তার অস্তিত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন। তিনি তাঁর চারপাশের সৃষ্টিজগত, চন্দ্র, সূর্য, তারকা পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এসব পরিবর্তনশীল বস্তুর পেছনে একজন অপরিবর্তনীয় নিয়ন্ত্রক রয়েছেন, যিনিই হলেন একমাত্র উপাস্য। যৌবনে পদার্পণ করে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তাঁর কওমের প্রচলিত মূর্তিপূজার অসারতা তুলে ধরেন এবং এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে সকলকে আহ্বান জানান। তিনি যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, এই প্রাণহীন মূর্তিগুলো কারো কোনো উপকার বা অপকার করতে অক্ষম।
তাঁর এই বিপ্লবী আহ্বানে তৎকালীন সমাজপতি ও পুরোহিত শ্রেণি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এমনকি তাঁর নিজ পিতাও তাঁর প্রতি বিরূপ হন। সমাজের ক্ষমতাধর এবং অহংকারী শাসক নমরুদ হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর একত্ববাদের প্রচার থেকে বিরত করার জন্য সকল প্রকার ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু হযরত ইবরাহিম (আ.) ছিলেন তাঁর বিশ্বাসে অটল। অবশেষে, নমরুদ তাঁকে জনসমক্ষে পুড়িয়ে মারার জন্য এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে এবং তাঁকে সেই আগুনে নিক্ষেপ করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধুর জন্য সেই ভয়াবহ আগুনকে শীতল ও শান্তিদায়ক করে দেন, যা ছিল এক সুস্পষ্ট মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনা। এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি ‘খলিলুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর বন্ধু’ নামে বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন।
এরপর আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাঁর জন্মভূমি ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে হিজরত করেন, সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী হযরত সারা (আ.) এবং পরবর্তীতে হযরত হাজেরা (আ.) ও পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)। তাঁর সমগ্র জীবন ছিল আল্লাহর প্রতি গভীরতম প্রেম, অবিচল আস্থা ও নিঃশর্ত আনুগত্যের ধারাবাহিক পরীক্ষায় পরিপূর্ণ। জীবনের সায়াহ্নে এসে, বহু প্রার্থনার পর আল্লাহ তাঁকে দুটি পুত্র সন্তান দান করেন – হযরত ইসমাইল (আ.) ও হযরত ইসহাক (আ.), যাঁরা উভয়েই পরবর্তীতে আল্লাহর নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।
হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের আরও একটি অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা শুরু হয় যখন আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দেন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হযরত হাজেরা (আ.) এবং তাঁদের দুগ্ধপোষ্য শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-কে তৎকালীন জনমানবশূন্য, শুষ্ক ও উত্তপ্ত মক্কা উপত্যকায় (যার প্রাচীন নাম ছিল বাক্কা) রেখে আসার জন্য। চতুর্দিকে কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন ছিল না, ছিল না কোনো পানীয় বা খাদ্যের সংস্থান। এমন বৈরী পরিবেশে একজন মমতাময়ী মা ও তাঁর দুধের শিশুকে রেখে আসার নির্দেশ পালন করা যে কোনো মানুষের পক্ষেই অত্যন্ত কষ্টকর। কিন্তু হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর এই নির্দেশ প্রাপ্তির পর কোনো প্রকার প্রশ্ন বা দ্বিধা না করে তা পালনে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হন। তিনি সামান্য কিছু খেজুর ও এক মশক পানি সহ হযরত হাজেরা (আ.) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কাবার নিকটবর্তী (তখনও কাবাঘর পুনর্নির্মিত হয়নি) একটি স্থানে রেখে, সকল মায়া ত্যাগ করে, কেবল আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করে সেখান থেকে ফিরে আসেন।
কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর যখন সঙ্গে থাকা খাবার ও পানি নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) তীব্র পানির পিপাসায় ছটফট করতে থাকেন। পুত্রের এই করুণ অবস্থা দেখে মা হযরত হাজেরা (আ.) দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি পানির সন্ধানে নিকটবর্তী দুটি ছোট পাহাড় – সাফা ও মারওয়ার মধ্যে পাগলের মতো সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন, যদি কোথাও পানির সন্ধান মেলে বা কোনো কাফেলার দেখা পান এই আশায়। জনমানবহীন মরু প্রান্তরে তাঁর এই আকুল ছোটাছুটি ও আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকেই স্মরণ করে হজের সময় সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাঈ করা হাজীদের জন্য ওয়াজিব বা অবশ্যকরণীয় আমল হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে।
হযরত হাজেরা (আ.)-এর এই চরম আকুতি ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা তাঁর অশেষ রহমতে ফেরেশতা হযরত জিব্রাইল (আ.)-কে প্রেরণ করেন। জিব্রাইল (আ.) এসে শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের কাছ থেকে মাটির বুক চিরে এক সুপেয় পানির ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করান, যা আজ লক্ষ কোটি মানুষের তৃষ্ণা নিবারণকারী পবিত্র ‘জমজম কূপ’ নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এই অলৌকিক পানির সন্ধান পাওয়ার পর ধীরে ধীরে সেখানে পাখি ও জীবজন্তুর আনাগোনা শুরু হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মানুষজন সেখানে বসতি স্থাপন করে, যার ফলে আজকের মক্কা নগরীর গোড়াপত্তন ঘটে। হযরত হাজেরা (আ.)-এর সেই দিনের আত্মত্যাগ, অসীম ধৈর্য, এবং এক আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও নির্ভরতা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য, বিশেষত নারীদের জন্য, এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা ও অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে রয়েছে।
হযরত ইসমাইল (আ.) যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন এবং পিতার সাথে চলাফেরা ও কাজকর্ম করার বয়সে উপনীত হন, তখন হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে আরও এক অভাবনীয় ও মানবীয় উপলব্ধির ঊর্ধ্বে এক কঠিনতম পরীক্ষার মুখোমুখি হন। তিনি পরপর তিন রাত স্বপ্নে দেখেন যে, আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু, তাঁর কলিজার টুকরা, বহু কাঙ্ক্ষিত পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-কে নিজ হাতে কোরবানি করার জন্য। নবীদের স্বপ্ন সাধারণ মানুষের স্বপ্নের মতো নয়, তা এক প্রকার ওহী বা ঐশী নির্দেশ। প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখার পর হযরত ইবরাহিম (আ.) কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়েছিলেন যে এটি কি আল্লাহর পক্ষ থেকে, নাকি শয়তানের কোনো কুমন্ত্রণা। কিন্তু পরপর একই স্বপ্ন দেখার পর তাঁর কাছে এটি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এটি আল্লাহরই নির্দেশ এবং এই নির্দেশ তাঁকে পালন করতেই হবে।

এই চরম কঠিন নির্দেশ প্রাপ্তির পর হযরত ইবরাহিম (আ.) সামান্যতম বিচলিত না হয়ে, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তা পালনে মনেপ্রাণে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। তিনি জানতেন, আল্লাহর নির্দেশের বাইরে কোনো কল্যাণ নেই। তবে, তিনি এই বিষয়টি তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-এর সাথে অত্যন্ত স্নেহ ও ভালোবাসার সাথে আলোচনা করেন। তিনি পুত্রের মতামত জানতে চান। পবিত্র কুরআনে এই ঐতিহাসিক ও হৃদয়স্পর্শী পিতা-পুত্রের কথোপকথন অত্যন্ত চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইসমাইল (আ.) পিতার নিকট থেকে আল্লাহর এই নির্দেশের কথা শুনে বিন্দুমাত্র ভয় বা দ্বিধা প্রকাশ না করে অত্যন্ত শান্ত, ধীর ও দৃঢ়তার সাথে উত্তর দেন, “হে আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি দ্বিধাহীন চিত্তে তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ (আল্লাহ যদি চান), আপনি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল ও সহনশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০২)। কৈশোর উত্তীর্ণ এক বালকের মুখ থেকে এমন অভাবনীয় আনুগত্য, আল্লাহর প্রতি এমন গভীর বিশ্বাস এবং পিতার প্রতি এমন সম্মানজনক প্রত্যুত্তর হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর সংকল্পে আরও বহুগুণে দৃঢ় করে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর পুত্রও আল্লাহর একজন সত্যিকারের অনুগত বান্দা।
পিতা ও পুত্র উভয়েই যখন আল্লাহর নির্দেশ পালনের এই কঠিনতম ব্রত নিয়ে মিনা প্রান্তরের দিকে (যেখানে কোরবানি করার জন্য নির্দেশিত হয়েছিলেন) রওনা হন, তখন মানবজাতির চিরশত্রু শয়তান তাঁদের এই মহান ও ত্যাগপূর্ণ কাজ থেকে বিরত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। শয়তান জানত, যদি হযরত ইবরাহিম (আ.) এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, তবে মানবজাতির জন্য তা এক অনন্য আদর্শ স্থাপিত হবে। তাই সে তিনবার বিভিন্ন স্থানে এসে তাঁদেরকে নানাভাবে প্ররোচনা দেওয়ার চেষ্টা করে। শয়তান প্রথমে হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে এসে তাঁকে তাঁর পুত্রস্নেহের দোহাই দিয়ে, বার্ধক্যের অসহায়ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন থেকে বিরত করতে চায়। কিন্তু হযরত ইবরাহিম (আ.) শয়তানের এই কুমন্ত্রণা ও ধোঁকা বুঝতে পেরে তাকে পাথর নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করেন।
এরপর শয়তান হযরত হাজেরা (আ.)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে মাতৃত্বকালীন স্নেহ ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা আশঙ্কার কথা বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু তিনিও শয়তানকে পাথর মেরে তাড়িয়ে দেন। সবশেষে, শয়তান হযরত ইসমাইল (আ.)-এর কাছে গিয়ে তাঁকে জীবনের মায়া এবং ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতে প্ররোচিত করে, কিন্তু হযরত ইসমাইল (আ.)ও পিতার মতোই শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে প্রতিহত করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যই হজের সময় হাজীরা মিনার নির্দিষ্ট তিনটি স্থানে (জামারাত) শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপের আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। এটি মূলত আল্লাহর নির্দেশ পালনের পথে সকল প্রকার শয়তানি বাধা, প্রলোভন ও অভ্যন্তরীণ রিপুর প্ররোচনাকে প্রতিহত করার এক বলিষ্ঠ প্রতীকী আমল।
অবশেষে, সকল বাধা ও প্ররোচনা উপেক্ষা করে হযরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-কে মিনায় কোরবানির জন্য আল্লাহর নির্দেশিত স্থানে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তিনি পুত্রকে আল্লাহর ইচ্ছার কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। হযরত ইসমাইল (আ.) অত্যন্ত প্রশান্ত চিত্তে নিজেকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হন। পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দেন এবং তাঁর নিজের চোখ কাপড় দিয়ে বেঁধে নেন, যাতে পুত্রস্নেহ তাঁর কর্তব্য পালনে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। কোনো কোনো বর্ণনামতে, হযরত ইসমাইল (আ.) নিজেই পিতাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে দিতে, যাতে তাঁর মুখমণ্ডল দেখে পিতার মনে দুর্বলতা না আসে এবং তাঁর হাত না কাঁপে।
অতঃপর হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নাম নিয়ে, সকল আবেগ ও স্নেহকে কোরবান করে, ধারালো ছুরি পুত্রের গলায় চালাতে উদ্যত হন। ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন ছুরি হযরত ইসমাইল (আ.)-এর গলা স্পর্শ করতে যাবে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। হযরত জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে একটি জান্নাতি দুম্বা (মোটাতাজা ভেড়া) নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং হযরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে সেই দুম্বাটিকে কোরবানি করার জন্য হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে নির্দেশ দেন। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর অতুলনীয় ত্যাগ, অকল্পনীয় আনুগত্য এবং তাঁর পুত্রের বিস্ময়কর আত্মসমর্পণে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং তাঁর কোরবানি কবুল করে নেন। তিনি তাঁর প্রিয় পুত্রকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এই মহিমান্বিত ঘটনা সম্পর্কে বলেন, “অতঃপর যখন তারা উভয়েই (পিতা ও পুত্র) আল্লাহর আদেশের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে (কোরবানির জন্য) কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম! তুমি তো তোমার স্বপ্নকে (আমার নির্দেশকে) সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্মপরায়ণ ও নিষ্ঠাবান বান্দাদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল (তোমার জন্য) এক সুস্পষ্ট ও কঠিন পরীক্ষা।’ এবং আমি তার (ইসমাইলের) পরিবর্তে এক মহান কোরবানির (অর্থাৎ, একটি হৃষ্টপুষ্ট পশু) ব্যবস্থা করলাম।” (সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ১০৩-১০৭)। এই ঘটনাই মূলত পবিত্র ঈদুল আজহার কোরবানির মূল প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক ভিত্তি। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে, তিনি মানুষের রক্ত বা প্রাণ চান না, তিনি চান মানুষের অন্তরের বিশুদ্ধতা, তাকওয়া বা খোদাভীতি, এবং তাঁর আদেশের প্রতি শর্তহীন ও আন্তরিক আনুগত্য।
কোরবানির এই মহান পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর সুযোগ্য পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-কে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন। সেটি হলো পবিত্র কাবা ঘর পুনর্নির্মাণের কাজ। কাবা ঘর পৃথিবীর বুকে নির্মিত সর্বপ্রথম ইবাদতখানা, যা মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে নির্মাণ করেছিলেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। সময়ের বিবর্তনে ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই পবিত্র ঘরের কাঠামো বিলীন বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-এর সহায়তায় সেই মূল ভিত্তির উপর কাবা ঘর পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। পিতা-পুত্র অক্লান্ত পরিশ্রম করে আল্লাহর এই ঘর পুনর্নির্মাণ করেন।
কাবা ঘর পুনর্নির্মাণের পর আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে নির্দেশ দেন সমগ্র মানবজাতিকে এই ঘরের দিকে হজের জন্য আহ্বান জানানোর জন্য। হযরত ইবরাহিম (আ.) নিকটবর্তী একটি পাহাড়ের (মতান্তরে আবু কুবাইস পাহাড়) উপরে দাঁড়িয়ে সেই আহ্বান জানালে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সেই আহ্বান পৃথিবীর সকল প্রান্তে, এমনকি যারা তখনো জন্মগ্রহণ করেনি তাদের আত্মাসমূহ পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সেই থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান কাবা ঘরের দিকে ছুটে আসেন হজব্রত পালনের জন্য, যা মূলত হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর সেই ঐতিহাসিক আহ্বানেরই বাস্তব প্রতিধ্বনি।
কালের দীর্ঘ পরিক্রমায় আরবের লোকেরা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রচারিত একত্ববাদের মূল শিক্ষা থেকে ধীরে ধীরে বিচ্যুত হয়ে পড়ে এবং পুনরায় শিরক ও মূর্তিপূজার মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়। তারা পবিত্র কাবা ঘরের অভ্যন্তরে ও চত্বরে ৩৬০টি বিভিন্ন মূর্তি স্থাপন করে এবং হজ ও কোরবানিসহ বিভিন্ন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় নানাবিধ কুসংস্কার, বিকৃতি ও অংশীবাদের মিশ্রণ ঘটায়। তারা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো হজের মাস ও নিয়মকানুন পরিবর্তন করে ফেলেছিল। পশু কোরবানি দেওয়া হতো বিভিন্ন দেব-দেবীর নামে, এবং সেই পশুর রক্ত কাবার দেওয়ালে লেপে দেওয়া হতো, যা ছিল ইবরাহিমি আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
অবশেষে, মানবজাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করেন। নবী করিম (সা.) যখন নবুয়ত লাভ করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সাথে সমাজে প্রচলিত সকল প্রকার শিরক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রকৃত ও বিশুদ্ধ একত্ববাদের শিক্ষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি নিজ হাতে পবিত্র কাবা ঘরকে সকল প্রকার মূর্তিমুক্ত করেন এবং হজ ও কোরবানির নিয়মাবলীকে সকল প্রকার বিকৃতি ও অংশীবাদ থেকে পবিত্র করে আল্লাহর নির্দেশিত ও হযরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থায় পুনঃস্থাপন করেন।
হিজরি দ্বিতীয় সন থেকে পবিত্র ঈদুল আজহা এবং এই দিনে পশু কোরবানি করা মুসলিমদের জন্য ওয়াজিব (ইমাম আবু হানিফার মতানুযায়ী, যা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে অনুসৃত) বা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। নবী করিম (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় নিজে নিয়মিত কোরবানি করেছেন এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরামকেও কোরবানি করার জন্য উৎসাহিত ও নির্দেশ প্রদান করেছেন। তাঁর জীবনের সর্বশেষ হজ, যা বিদায় হজ নামে পরিচিত, সেই হজে তিনি যে সকল আমল সম্পাদন করেছিলেন এবং যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন, তা আজও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা ও পথনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হয়।

পবিত্র ঈদুল আজহা নিছক একটি পশু জবাই এবং আনন্দ-উৎসবের দিন নয়। এর প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতার পেছনে রয়েছে মানবজাতির জন্য বহুবিধ গভীর শিক্ষা, তাৎপর্য এবং আধ্যাত্মিক বার্তা। প্রথমত, এই উৎসব আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। হযরত ইবরাহিম (আ.) ও হযরত ইসমাইল (আ.) যেভাবে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আল্লাহর কঠিনতম আদেশ পালনে ব্রতী হয়েছিলেন, তা আমাদের জীবনেও আল্লাহর সকল বিধি-বিধান মেনে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়। দ্বিতীয়ত, ঈদুল আজহা আমাদের ত্যাগ ও উৎসর্গের মহান শিক্ষা দেয়। নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে।
এই ত্যাগ কেবল পশুর রক্ত প্রবাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর দ্বারা আমাদের অভ্যন্তরীণ পশুত্ব, অর্থাৎ ষড়রিপু – কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে দমন করা, নিজের অহংকার, আমিত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, কৃপণতা ইত্যাদি যাবতীয় মন্দ স্বভাবকে কোরবান করার শিক্ষাও নিহিত রয়েছে। তৃতীয়ত, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন, “আল্লাহর কাছে না পৌঁছায় সেগুলোর গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ, আয়াত: ৩৭)। অর্থাৎ, পশু কোরবানির মাধ্যমে আমরা কতটা আল্লাহসচেতন ও তাঁর প্রতি অনুগত হতে পারলাম, সেটাই মুখ্য বিষয়।
চতুর্থত, ঈদুল আজহা মুসলিম সমাজে ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও সামাজিক সংহতি সুদৃঢ় করার এক অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। কোরবানির মাংসকে তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ নিজের পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের জন্য এবং অপর এক ভাগ সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষদের মধ্যে বিতরণ করার যে বিধান ইসলাম দিয়েছে, তা সামাজিক সাম্য, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধনকে মজবুত করে। এর মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ঘুচে যায় এবং সকলে মিলে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ পায়।
পঞ্চমত, হযরত ইবরাহিম (আ.), হযরত ইসমাইল (আ.) ও হযরত হাজেরা (আ.)-এর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রদর্শিত অসীম ধৈর্য, অবিচল সহনশীলতা এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা ও নির্ভরতা আমাদের জন্য কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা রেখে ধৈর্য ধারণ করার শিক্ষা দেয়। ষষ্ঠত, এই উৎসব আল্লাহর অগণিত নিয়ামত, বিশেষ করে জীবন, সম্পদ ও পরিবারের মতো মূল্যবান দানের জন্য তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া প্রকাশ করার এক বিশেষ উপলক্ষ। একইসাথে, আল্লাহর নির্দেশিত সরল ও সঠিক পথে নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করার নতুন করে অঙ্গীকার করার দিনও এটি।
পরিশেষে বলা যায়, পবিত্র ঈদুল আজহা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি মানব ইতিহাসের এক মহান অধ্যায়ের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এটি হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর অতুলনীয় ঈমানের দৃঢ়তা, হযরত ইসমাইল (আ.)-এর বিস্ময়কর আত্মনিবেদন ও আনুগত্য এবং হযরত হাজেরা (আ.)-এর অসাধারণ ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার এক চিরন্তন স্মৃতিফলক। এই উৎসব প্রতি বছর মুসলিম উম্মাহকে আত্মশুদ্ধি, আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থপরতা, উৎসর্গ এবং আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ ও শর্তহীন আনুগত্যের এক নবতর চেতনায় উজ্জীবিত করে।
কোরবানির পশুর রক্ত প্রবাহের সাথে সাথে আমাদের অন্তর থেকে সকল প্রকার কলুষতা, সংকীর্ণতা ও পশুসুলভ প্রবৃত্তি দূরীভূত হোক, আমরা যেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর মতো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারি – এই হোক পবিত্র ঈদুল আজহার মূল প্রার্থনা ও অঙ্গীকার। এই ঈদের প্রকৃত আনন্দ ও শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ুক ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড় নির্বিশেষে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের হৃদয়ে, এবং এর মাধ্যমে স্থাপিত হোক পারস্পরিক ভালোবাসা, সাম্য, মৈত্রী ও সৌহার্দ্যের এক সুন্দর, শান্তিময় ও কল্যাণকর সমাজ।