
আজ ২৫ জুলাই, বিশ্ব আইভিএফ দিবস। সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতিদের জন্য আশার আলো হয়ে ওঠা এই চিকিৎসা পদ্ধতিটি বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে নানা আয়োজনে। এই প্রেক্ষাপটে বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার প্রসার ঘটলেও সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ না থাকায় ব্যয়বহুল বেসরকারি হাসপাতালই এখানকার দম্পতিদের একমাত্র ভরসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আইভিএফ সেবা চালু হলে এ অঞ্চলের হাজারো দম্পতির ভোগান্তি কমত।
চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা আহসানুল হক ও হুসনা আরা (ছদ্মনাম) দম্পতি। বিয়ের প্রায় ১৫ বছর কেটে গেলেও তাদের ঘরে আসেনি কোনো সন্তান। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন চিকিৎসার পর অবশেষে তারা আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আহসানুল হক বলেন, “প্রথমে আমরা কলকাতা বা ঢাকার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু যাতায়াত, দীর্ঘ সময় থাকা এবং সার্বিক খরচ মিলিয়ে বিশাল এক ধাক্কা। এখন শুনছি, চট্টগ্রামেও উন্নত মানের আইভিএফ সেন্টার হয়েছে। তাই এখানেই চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে খরচটা অনেক বেশি। সরকারি হাসপাতালে এই সুবিধা থাকলে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য বড় আশ্রয় হতো।”
শুধু এই দম্পতিই নন, একসময় চট্টগ্রামের বহু নিঃসন্তান দম্পতি চিকিৎসার জন্য ভারত বা ঢাকায় পাড়ি জমাতেন। তবে গত পাঁচ-ছয় বছরে নগরীতে বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকটি বিশেষায়িত আইভিএফ সেন্টার গড়ে উঠেছে, যাদের সাফল্যের হার বিদেশের উন্নত কেন্দ্রের সমতুল্য। ফলে বিদেশমুখিতা কমেছে এবং স্থানীয়ভাবে সেবা নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভিসা, যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচ মিলিয়ে মূল চিকিৎসার চেয়ে আনুষঙ্গিক ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কর্মজীবী দম্পতির পক্ষে লম্বা ছুটি নিয়ে বাইরে থাকাও কঠিন। এর বিপরীতে এখন চট্টগ্রামেই আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক রয়েছেন। এসব কারণে নগরীর দম্পতিরা এখন স্থানীয় চিকিৎসাতেই আস্থা রাখছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এক বছর চেষ্টার পরও সন্তান ধারণে ব্যর্থ হলে সেই দম্পতিকে বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় আক্রান্ত বলে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন, যার একটি বড় অংশ চট্টগ্রামে বসবাস করেন। সন্তান না হওয়ার পেছনে নারী-পুরুষ উভয়েরই শারীরিক সমস্যা থাকতে পারে।
তবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, দেশের একমাত্র সরকারি আইভিএফ কেন্দ্রটি ঢাকা মেডিকেলে অবস্থিত, যেখানে রোগীর চাপ বিশাল। অথচ চট্টগ্রামে এ নিয়ে কোনো সরকারি উদ্যোগই নেই।
নগরীর একটি বেসরকারি ফার্টিলিটি সেন্টারের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, “আগে বন্ধ্যাত্বের জন্য নারীদের সমস্যাকে বেশি দায়ী করা হলেও এখন আমরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুরুষ রোগীর শুক্রাণুর সমস্যা পাচ্ছি। চট্টগ্রামে বেসরকারিভাবে ল্যাপারোস্কপি থেকে শুরু করে আইভিএফ পর্যন্ত সব আধুনিক চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু এটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকের নাগালের বাইরে থেকে যায়। চমেক হাসপাতালে একটি পূর্ণাঙ্গ আইভিএফ বিভাগ চালু করা এখন সময়ের দাবি।”
সন্তানহীনতা দম্পতিদের জন্য প্রায়ই তীব্র সামাজিক ও মানসিক সংকট তৈরি করে। পারিবারিক অনুষ্ঠানে এড়িয়ে চলা, একঘরে হয়ে পড়া এমনকি দাম্পত্য কলহ ও বিচ্ছেদের মতো ঘটনাও ঘটে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, “বিয়ের নয় বছর হয়ে গেছে। ‘কেন বাচ্চা হয় না’—এই প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এখন নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছি।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি পর্যায়ে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসাকে সহজলভ্য করা গেলে একদিকে যেমন বহু দম্পতির স্বপ্ন পূরণ হবে, তেমনি তারা সামাজিক সংকট থেকেও মুক্তি পাবেন। বিভাগীয় শহর হিসেবে চট্টগ্রামে দ্রুত একটি সরকারি আইভিএফ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা তাই অত্যন্ত জরুরি।