বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

শিক্ষিত তরুণরা বেকার কেন, উত্তরণের পথ কী?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৯:৪০ পূর্বাহ্ন


আমাদের দেশ এক ভয়াবহ শ্রমবাজার সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, অন্যদিকে অদক্ষ শ্রমিকের বিশাল এক বাহিনী—এই উভয় সংকট দেশের অর্থনীতিকে এক জটিল আবর্তে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপের দিকে তাকালে পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রতি তিনজনের একজন কর্মহীন। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ২৯ শতাংশে পৌঁছেছে। এই পরিসংখ্যানগুলো কেবল সংখ্যা নয়, বরং লক্ষ লক্ষ তরুণের স্বপ্নভঙ্গ আর দেশের অর্থনীতির জন্য এক অশনিসংকেত। এমন এক পরিস্থিতিতে আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের একমাত্র পথ হলো ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, যার কোনো বিকল্প নেই।

এটা অনস্বীকার্য যে, গত সরকারের পতনের পর দেশের অর্থনীতি এক বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঋণের মাধ্যমে ব্যয় নির্বাহের চেষ্টা করছে। গত এক বছরে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক ধারা দেখা গেলেও সার্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হয়নি। এই সময়ে নতুন বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানের ওপর। নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হওয়া তো দূরের কথা, বরং বহু মানুষ তাদের কর্ম হারিয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর মতো শিল্পাঞ্চলগুলোতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও সঙ্গীন। বিক্রি কমে যাওয়া, নতুন পণ্য তুলতে না পারা এবং কর্মচারীদের বেতন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পথে। কিছু শ্রমিক হয়তো কম বেতনে অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিয়েছেন, কিন্তু হাজার হাজার শ্রমিক এখনো কর্মহীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

বিশেষজ্ঞরা এই সংকটের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং চাকরির বাজারের চাহিদার মধ্যে এক বিশাল অসামঞ্জস্য বিদ্যমান। বছরের পর বছর ধরে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ লক্ষ স্নাতক তৈরি করছে, কিন্তু তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা বর্তমান বাজারের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও তরুণরা চাকরির বাজারে প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থানের সুযোগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঞ্চলিক বৈষম্য রয়ে গেছে। উন্নয়ন ও শিল্পায়ন মূলত কয়েকটি নির্দিষ্ট শহরকে কেন্দ্র করে হওয়ায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ পিছিয়ে পড়ছে। এই দ্বিমুখী সংকট আমাদের মানবসম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহারে বাধা দিচ্ছে।

এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা একটি মূল বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন, আর তা হলো নতুন বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া নতুন শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে না, আর প্রতিষ্ঠান ছাড়া নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয় না। যখন মানুষের হাতে কাজ থাকে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এর ফলে বাজারে চাহিদা তৈরি হয়, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করে। তাই সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ হওয়া উচিত বিনিয়োগের পথকে মসৃণ করা। বর্তমানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার। সুদের হার বেশি হওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না, যা বিনিয়োগ প্রবাহকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

আশার কথা হলো, গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা নিম্নমুখী। আগস্ট ২০২৫-এ মূল্যস্ফীতির হার ৮.২৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত প্রায় দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের উচিত নীতিগত পর্যালোচনার মাধ্যমে ঋণের সুদহারকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা, যাতে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হন।

বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি আরও কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো দূর করার জন্য আধুনিক বাণিজ্যব্যবস্থাকে (মডার্ন ট্রেড) প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। সুপারশপগুলোর ওপর আরোপিত ভ্যাট ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা তারা অনেক সময় নিজেরাই বহন করে। এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করা সম্ভব। এতে খাদ্যের অপচয় কমবে, কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে এবং সরকারের কাছেও বাজার সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকবে। এর পাশাপাশি, সরকারের উচিত অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন করে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো।

একটি দেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে না পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি সুদূরপরাহত থেকে যাবে। একইভাবে, খাদ্যপণ্যের অপচয় রোধে হিমাগার এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কৃষি খাতে সারসহ অন্যান্য ভর্তুকি চলমান রাখা অত্যন্ত জরুরি। একটি জাতীয় ‘ফুড বাফার পলিসি’ বা খাদ্য মজুদ নীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।

বর্তমান সরকার পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর, যা প্রশংসার যোগ্য। তবে এই তৎপরতাকে টেকসই করতে হলে পরিবেশবান্ধব শিল্পকে উৎসাহ দিতে হবে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার, বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক এবং সৌরবিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বা বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা পাবে, তেমনই নতুন একটি অর্থনৈতিক খাতের বিকাশ ঘটবে এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পরিশেষে, এটা স্পষ্ট যে দেশের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের মূল চাবিকাঠি হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি। আর সেই কর্মসংস্থান তৈরির জন্য প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি স্থিতিশীল এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নীতি নির্ধারকদের, বিশেষ করে অর্থ উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে, শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যা সমাধান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সকল নাগরিক, উদ্যোক্তা এবং সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করতে এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।