ফয়সাল করিম: নেতিবাচক অনেক অভিজ্ঞতার ভিড়ে পুলিশের সাহসিকতা আর মানবিকতার গল্পগুলো খুব কমই সামনে আসে। মানবিক গল্পে যে পুলিশ নায়ক চরিত্রে অবতীর্ণ হতে পারে, তেমন অনেক উদাহরণই চাপা পড়ে যায় হাজারো ঘটনার ভিড়ে। তেমনই একটি অপ্রকাশিত গল্প একুশে পত্রিকা পাঠকের জন্য।
ফেরা যাক চার বছর আগে। ২০১৩ সালের শুরুর দিকে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়, ছিল হিমেল ঠাণ্ডার সাথে কুয়াশার দাপট। রাতের গুমোট অন্ধকার মাড়িয়ে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের পথ ধরেছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। রোগী নেই, তাই তেল খরচ পুষিয়ে নিতে চালক তুলে নিয়েছে কিছু যাত্রী। টগবগে যুবক দুলাল। তার বেপরোয়া চালনায় যাত্রীবোঝাই অ্যাম্বুলেন্সটি কুয়াশাচ্ছন্ন পিচঢালা পথ ধরে এগিয়ে যায়। কক্সবাজার পেরিয়ে চকরিয়ায় আসলে গতি বাড়ায় সে, হয়ত রাত গভীর হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম পৌঁছুনোর তাড়া।
হঠাৎ ব্রেক কষার তীক্ষ্ম আওয়াজ! নীরবতা ভাঙে নির্জন সড়কের। লোহালক্কর আছড়ে পড়ার প্রচণ্ড শব্দে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে আশপাশের মানুষ। ততক্ষণে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি লবণবোঝাই ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মাইক্রোবাসটি থেকে ভেসে আসতে শুরু করেছে কান্না আর গোঙানির শব্দ। ঘটনাস্থলেই প্রাণ যায় চালক দুলালের। এক নারীসহ গুরুতর আহত যাত্রীদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ড। রাত আনুমানিক ১২টা। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অজ্ঞাত এক পুরুষ যাত্রীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টায় চিকিৎসকেরা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। শরীরের বিভিন্ন জখমের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে একসময় রেহাই মিলল তার, তবে প্রাণের বিনিময়ে। অনেক খোঁজাখুজি সঙ্গে থানা-পুলিশ আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন হল। তারপরও যুবকের নাম পরিচয়ের দাবী নিয়ে এলো না কোনো স্বজন। অগত্যা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হল মরদেহ।
অন্য প্রান্তে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে একই দুর্ঘটনায় আহত গার্মেন্টকর্মী আঁখি বেগম। ট্রাকের সাথে প্রচণ্ড ধাক্কায় শরীরের নিচের অনেক অংশ থেতলে যাওযায়, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। হাঁটু থেকে গোড়ালি অবধি অবিরত রক্তক্ষরণে সে ভুলেই গিয়েছিল দু-পায়ের অস্তিত্ব। অনেকটা অচেতন থাকায় প্রথম ক’দিন তার নাম-ধামেরও কুল কিনারা পায়নি পুলিশ। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টায় ক’দিনের সেবা-যত্নে ধীরে ধীরে বোধ ফিরে আসে মেয়েটির। জানায় নিজের পরিচয়, দুর্ঘটনার আদ্যোপান্ত। কথায় কথায় নাম না জানা সেই নিহত যুবকের কথা আঁখিকে জিজ্ঞেস করে পুলিশ। এরপরই যেন আকাশ ভেঙে পড়ে মেয়েটির মাথায়। তীব্র চিৎকারে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফুপিয়ে উঠে জানায়, নিহত যুবকটি তার স্বামী। নতুন বিয়ের তাই দুজনে মিলে ঘুরতে যাওয়া, কক্সবাজার। ফেরার পথেই, দুর্ঘটনা।
ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল ইসলামের সহায়তায় মেয়েটির অভিভাবকদের খোঁজ মেলে ক’দিন পর। আহত মেয়ের সন্ধান পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন দরিদ্র বাবা-মা। সন্তানকে জীবিত দেখে ক্ষণিক সুখের অনুভূতি হয় তাদের। পরক্ষণেই শঙ্কা দানা বাঁধে। চিকিৎসক জানান, অল্প কদিনের মধ্যেই আঁখির দু-পায়ে অস্ত্রোপচার করা জরুরি। নইলে সারা জীবনের পঙ্গুত্বের আশঙ্কা। সবমিলিয়ে খরচ কমপক্ষে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা।
এসব শুনে অনিশ্চয়তার দোলাচলে পড়ে আঁখির দরিদ্র পরিবার। তাদের অসহায়ত্বের কথা বুঝতে পেরে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেন পুলিশ কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম। স্বামীহারানো মেয়েটিকে বাঁচানোর তীব্র অনুভূতি তাড়া করে তাকে। যোগাযোগ শুরু করেন নানা মহলে। ধর্ণা দেন মহৎ হৃদয়ের বিত্তশালীদের কাছে। টাকা জোগাড়ের আগ পর্যন্ত নিজ পকেটের খরচে চালিয়ে নেন আঁখির বেশ কদিনের ওষুধ খরচও। এরমধ্যেই আসে সুখবর, আঁখির অস্ত্রোপচারের যাবতীয় ব্যয়ভার বহনে রাজি হন স্থানীয় এক আওয়ামীলীগ নেতা।
অবশেষে দুর্ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর দু-পায়ে জটিল অস্ত্রোপচার হয় আঁখির। ভাঙা হাড় জোড়া দিতে স্থাপন করা হয় কৃত্রিম রড। অবশেষে চার মাসের মাথায় ২০১৩ সালের মাঝামাঝি দু-পায়ে রড নিয়েই ঘরে ফেরে আঁখি।
তার জীবনের মাঝখানের গল্প, সংগ্রাম আর নতুন করে বাঁচতে শেখার। তবে সে গল্পে আবারও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পা দুটোই। চার বছর পর এ বছরের শুরুতে পা দুটোই ব্যাথা উঠে, ফুলে ফেপে একাকার হয় তার গোড়ালি আর হাঁটু। রডগুলো খোলার সময় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। অথচ এতদিন খুব একটা সমস্যা না থাকায় সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি আঁখি। আবারো নতুন অনিশ্চয়তা দানা বাঁধে। ভর করে অর্থের অভাবে পা হারানোর আশঙ্কা। এবারো খবর পৌছে যায় জহিরুলের কাছে। দেরি না করে নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেন সদ্য পদোন্নতি পাওয়া ইন্সপেক্টর জহির। শুরু হয় নতুন অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি। ফাঁড়ির অন্য পুলিশ সদস্য, নিজের পকেটের অর্থ আর নানা উৎস থেকে বন্দোবস্ত করেন দশ হাজার টাকার খরচ। সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে এ বছরের জানুয়ারির শেষদিকে সফলভাবেই সম্পন্ন হয় আঁখির পায়ের রড খোলার অস্ত্রোপচার।
গেল ২০ জানুয়ারি হাসপাতাল ছাড়ার আগমুহূর্তে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়। জানান, জহিরুলের মত পুলিশ সদস্যের কল্যাণে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে তাদের মেয়ে। এভাবে বারবার মেয়ের চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে আসায় জহিরুলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতার ছাপ তাদের চোখেমুখে। অনুভূতি বলতে গিয়ে আনন্দ মাখামাখি হয় তাদের চোখের জলে। কথা হয় আঁখির সঙ্গেও। দুর্বল মুখের প্রত্যয়ী হাসিতে জানায়, এখন থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। এখন থেকে নিজ পায়েই জীবনের বাকি পথটুকু হেঁটে যাওয়ার পালা।
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে ছুটে যাই জহিরুল ইসলামের কাছে। মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বললেন, হাসপাতালের চাকরি বড়ই নির্মম। দীর্ঘদিন এমন কর্মস্থলে থেকে মৃত্যু আর রোগ-শোক দেখার অভ্যস্ততা অনেকটা সকাল-বিকালের নাস্তার মতই। এরপরও কথা থাকে। অনেক ঘটনা, অসহায়ত্ব আর মৃত্যু নাড়া দিয়ে যায় তার মন, তখন হয়ে উঠেন পুরোদস্তুর মানবতাবাদী। পোশাকি দায়িত্বের হিসেব না কষে এগিয়ে যান অসহায় মানুষের সহায়তায়।
ফেরার সময় হাসপাতালের অনেকের সঙ্গেই কথা হল। জানলাম, আঁখি ছাড়াও অসহায় এমন অনেক রোগীর সহায়তায় তার এগিয়ে আসার গল্প। সেসব অপ্রকাশিত গল্প না হয় আরেকদিন…
ফয়সাল করিম : চট্টগ্রাম ইনচার্জ, চ্যানেল নাইন