শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নকশা অনুমোদন দিচ্ছে না সিডিএ, মহাবিপাকে ৫ হাজার পরিবার

প্রকাশিতঃ ৯ নভেম্বর ২০২০ | ৭:১৯ অপরাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : ১৩ বছর ধরে নগরের দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেয়াবাদ এলাকায় নতুন কোনো ভবন নির্মাণের নকশার অনুমোদন দিচ্ছে না চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের অজুহাতে ২০০৭ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ভবনের নকশা অনুমোদন না দেয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা পড়েছেন মহাবিপাকে। সেই থেকে আবাসন প্রকল্প নামক উন্নয়নের কাঁটা বিঁধে আছে এই এলাকার বাসিন্দাদের গলায়।

সিডিএ সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে ৪ হাজার ৭শ’ একর জায়গার ওপর ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন ইন চট্টগ্রাম’ নামে আধুনিক উপশহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছিল সিডিএ। আর দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০১৩ সালের জুলাই মাসে মাস্টার প্ল্যানের নিদের্শনা অনুযায়ী হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদ এলাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেসময় দ্বিতীয় দফায় ভূমির পরিধি ৭ হাজার একরে উন্নীত করেছিল সিডিএ, যার বাস্তবায়নকাল ধরা হয় জুলাই ২০১৩ থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত।

এরপর সিডিএ ২০১৪ সালে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) জমা দেয়। প্রকল্পটির জন্য ৩০০ একর জমি প্রাথমিকভাবে অধিগ্রহণ করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে পারেনি সিডিএ। সিডিএ’র সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে।

তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে এই এলাকায় ভবনের নকশা অনুমোদন না দেয়ায় নতুন ভবন নির্মাণ করতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। শুধু তাই নয়, প্রস্তাবিত ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ আবাসন প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারে মোট দেড় লাখ হতদরিদ্র থেকে বিত্তশালী সকলেই রয়েছে ভূমি হারানোর আতঙ্কে।

প্রশ্ন উঠেছে, সিডিএ দফায় দফায় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ও ভূমির পরিমাণ বাড়াতে তৎপর থাকলেও ১৩ বছরেও কেন এর কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি? প্রকল্পের বাজেট নিয়ে সিডিএর চোখকান সজাগ থাকলেও এখনও ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াই আরম্ভ করতে না পারায় সন্দেহের আঙুল উঠছে সিডিএর দিকে।

উন্নয়নের এমন বিষফোড়া থেকে মুক্তি পেতে “বসতভিটা রক্ষা কমিটি” গঠন করেও বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, মিছিল এবং সমাবেশ করেও পরিত্রাণ পাননি স্থানীয় বাসিন্দারা। এই প্রকল্পে এলাকাবাসীর ক্ষতির বিষয়গুলো উল্লেখ করে সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল কমিটি থেকে। যেখানে প্রকল্পটি বাতিল করে এলাকায় ভবন নির্মাণের নকশার অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জায়গা-জমি হারাবে হাজার হাজার বাসিন্দা। এতে এলাকার শত বছরের পুরোনো পারিবারিক কবরস্থান ও শ্মশান, বসতবাড়ি সিডিএর এই প্রকল্পের কারণে হারানোর আশঙ্কার কথাও জানানো হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের ফতেয়াবাদ এলাকা ঘুরে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এলাকাটিতে ৫ হাজার পরিবারের মালিকানায় পাহাড় থেকে সমতল ভূমি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার একর জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে সিডিএ যে জায়গার প্রস্তাবনা দিয়েছে তার প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যক্তি মালিকানার।

স্থানীয় বেশ কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, ২০০৭ সাল থেকে সিডিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগে এলাকাবাসীর মধ্যে অনেকে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি চেয়ে নকশা অনুমোদনের আবেদন করেছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের অজুহাতে সিডিএ ভবনের নকশা অনুমোদন বন্ধ রাখায়, আমরা ভবন নির্মাণ করতে পারছি না। কিন্তু আরএস, পিএস ও বিএস জরিপ অনুযায়ী প্রতিবছর ঠিকই এসব জায়গার খাজনা পরিশোধ করতে হয় আমাদের।

ফতেয়াবাদ ছড়ারকুল এলাকার বাসিন্দা মোবারক আলী বলেন, ‘সিডিএ না দিচ্ছে ভবন নির্মাণের অনুমোদন না করছে তাদের প্রকল্প। আজ ১৩ বছর ধরে আমরা শরণার্থীদের মত জীবনযাপন করছি। আবাসন প্রকল্প হলে আমার মত এলাকার অনেকে বসতভিটা হারাবে। আমাদের কি হবে? আমাদের জায়গা অধিগ্রহণ করে সিডিএ কেন ব্যবসা করবে?’

জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীন উল ইসলাম খান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমরা ইতোমধ্যেই সার্ভের কাজ শুধু করেছি, যেখানে আমরা ড্রোনের মাধ্যমে আমাদের প্রকল্পের পুনঃনকশা করছি। খুব শীঘ্রই সার্ভের কাজ শেষ হবে। তারপর আমরা প্রকল্পের আওতায় নির্বাচিত জায়গা অধিগ্রহণ করে এর কাজ শুরু করে দিবো। আমি সার্ভে টিমের কাছে আজই এই কাজের অগ্রগতির বিষয়ে তথ্য নিবো।’

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমরা ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পুরো দমে মাঠে নেমেছি। আমাদের পরিকল্পনা আছে, আগামী ৫-৬ মাসের মধ্যে এই কাজ শুরু করার। ক্ষতিপূরণ দিয়ে জায়গা অধিগ্রহণের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের একটা সিদ্ধান্তও আমরা নিয়েছি। আশা করছি ফতেয়াবাদের মানুষের আর বেশিদিন কষ্ট করতে হবে না।’

নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, আবাসন সমস্যা নিরসনে একটির পর একটি প্রকল্প হাতে নিলেও সিডিএ এর কোনটি পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্ন করতে পারে নি। ১৩ বছর ধরে ‘ডেভেলপমেন্ট অব ফতেয়াবাদ নিউ টাউন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের অজুহাতে ওই এলাকায় ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। অথচ সেই কাজ শেষ না করে কল্পলোক আবাসিক, অনন্যা-১, অনন্যা-২ এরকম প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সিডিএ উঠে পড়ে লেগেছে।

তিনি আরো বলেন, ‘উল্লেখিত এসব প্রকল্পের প্লট বিক্রি হলেও হাতে গোনা কয়েকটি ভবন নির্মাণ ছাড়া বাকি জায়গাগুলো আগের মতোই খালি পড়ে আছে। তাহলে আবাসন সংকটের সমাধান কোথায় হলো? এগুলো সিডিএ’র উদাসীনতা এবং অপরিকল্পিত কার্যক্রমের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।’