বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আনোয়ারায় ‘ম্যানেজ’ করে চলছে অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার

প্রকাশিতঃ ১৪ নভেম্বর ২০২০ | ১১:০৭ অপরাহ্ন


জিন্নাত আয়ুব, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) : যথাযথ সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই আনোয়ারা উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে অন্তত ১৭টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলেও এখনও অনুমোদন পায়নি। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য কোনো আবেদনই করেনি।

অনুমোদন ছাড়াই আনোয়ারায় অবৈধ ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ব্যবসা করে গেলেও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় নির্বিকার রয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই চিকিৎসার নামে মানুষকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা। বিষয়টি স্বীকার করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চাতরী চৌমুহনী বাজারে এ্যাপোলো হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দি ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ১ ও ২, পপুলার হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শাহ মোহছেন আউলিয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্টার ক্লিনিক্যাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি, সেন্টারে বাজারে টাস কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বটতলী এস এম এম পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জনসেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইউনিট ১ ও ২, সূর্যের হাঁসি নেটওয়ার্ক ক্লিনিক, শোলকাটা সাইনিং ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আনোয়ারা সদর মা মনি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কালাবিবির দিঘির মোড়ে আনোয়ারা হলি হেলথ ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মহাল খান বাজারে ছায়াপথ ক্লিনিক ও বারশতে আইডিয়াল ক্লিনিক নামে উপজেলায় মোট ১৭টি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।

আনোয়ারার প্রতিটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার কোন মূল্য তালিকা নেই; এসব প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছেমত মূল্য নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বেশিরভাগ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাইনবোর্ড থাকলেও নেই ডাক্তার।

আনোয়ারা হলি হেলথ ক্লিনিক এবং সূর্যের হাসি নেটওয়ার্ক ক্লিনিকে প্রসূতির সন্তান প্রসবের সেবাদানের অনুমতি থাকলেও বাকিগুলোতে অনুমতি নেই। তবুও ছায়াপথ ক্লিনিক ও আইডিয়াল ক্লিনিকে সন্তান প্রসবের সেবাদান করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এসব ক্লিনিকে নেই কোনো জরুরি বিভাগ, অপরেশন থিয়েটার। নেই প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স।

সরেজমিনে বটতলী জনসেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার গিয়ে দেখা যায়, বিকল এক্সরে মেশিন। নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনো টেকনেশিয়ান। টেস্ট রুমগুলো দেখতে যেন কোনো বাসা বাড়ির রান্নাঘর।

বারশত আইডিয়াল ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভবনের নিচের ফ্লোরে চলছে সব কাজ। নেই কোনো ডাক্তার, নার্স। অভিযোগ রয়েছে, ধাত্রীর মাধ্যমে সেখানে সন্তান প্রসবের সেবাদান করানো হয়।

বটতলী এস এম এম পপুলার ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, ক্লিনিকের অনুমোদন নেই। অনুমোদন পেতে আবেদন করেই পুরোদমে চলছে কার্যক্রম।

এছাড়া আনোয়ারা সদরে মা মনি ল্যাবে গিয়ে দেখা যায়, নেই কোনো প্যাথলজি রুম। এক্স-রে মেশিন আছে, টেকনিশিয়ান নেই। হালনাগাদ লাইসেন্সও নেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, টাচ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক আবছার ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের উপর নিজেই মনগড়া রক্ত পরীক্ষা লিখে দেন এবং প্যাথলজি ও এক্স-রে তিনি নিজেই করেন। অথচ এ বিষয়ে তার কোনো ডিগ্রী বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই।

এছাড়া আবছারের পরিচালনাধীন আইডিয়াল ক্লিনিকে দেড় হাজার টাকায় প্রসূতি নারীর সন্তান প্রসবের সেবা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ক্লিনিকের নারী কর্মীদের কাজে লাগানো হয়। আইডিয়াল ক্লিনিকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করা হয় ৪৯০ টাকায়। অথচ এত কম টাকায় আল্ট্রাসনোগ্রাফি সেবা দেয়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আবছার বলেন, আমি দীর্ঘদিন মেডিকেলে চাকরি করেছি। আমার অভিজ্ঞাতা আছে। তাই রোগীদের খরচ কমানোর জন্য আমি নিজেই আল্ট্রাসনোগ্রাফি করি। এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রী আছে কি না জানতে চাইলে আবছার বিষয়টি এড়িয়ে যান।

এদিকে বিধি অনুযায়ী, বেসরকারি হাসপাতালের জন্য একজন সার্জন, তিনজন এমবিবিএস ও একজন এ্যানেসথেসিয়ার চিকিৎসক, বাংলাদেশ নার্সি কাউন্সিল অনুমোদিত ৬ জন ডিপ্লোমা নার্স, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট, পোস্ট অপারেটিভ রুম, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এর লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তারের ছাড়পত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেয়ার কথা থাকলেও আনোয়ারার ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো এসব কাগজপত্র দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেছে।

এছাড়াও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন ল্যাব টেকনেশিয়ান, একজন এক্স-রে টেকনেশিয়ান, একজন প্যাথলোজিস্ট, একজন রিপোর্ট প্রদানকারী চিকিৎসক ও একজন রেডিওগ্রাফার থাকার কথা থাকলেও তা নেই। এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চলছে চরম নৈরাজ্য। অভিযোগ রয়েছে, এ সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশের মান উন্নত না হলেও রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষায় নিরীক্ষায় অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয়।

আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবাবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু জাহিদ মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন একুশে পত্রিকাকে বলেন, এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে। তাই একটু ম্যানেজ করে চলতে হয়। তবে আমরা আনোয়ারায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর তালিকা তৈরি করেছি। অনুমোদনহীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি একুশে পত্রিকাকে বলেন, অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা করে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে অভিযান পরিচালনা করার জন্য আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।