মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘অপরাধ জগতে’ ওরা তিন ভাই

প্রকাশিতঃ ১৮ নভেম্বর ২০২০ | ৯:০১ পূর্বাহ্ন


চট্টগ্রাম : পারভেজ হোসেন, এরশাদ হোসেন ও মোরশেদ হোসেন— তারা তিন ভাই। পুলিশের খাতায় তিনজনই ‘অপরাধী’। তাদের ‘আমলনামা’য় আছে একাধিক হত্যা, অস্ত্র, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এবং মাদকের মামলা।

চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার পশ্চিম গুজরা মগদাই গ্রামের আবুল হোসেনের সন্তান এই তিনভাইয়ের মধ্যে কেউ গ্রেপ্তার হলে অন্য ভাইয়েরা ডাকাতি-চাঁদাবাজি করে ভাইয়ের জামিন করান। হাল ধরেন তাদের অপরাধ জগতের। এ যেন তিন অপরাধীর পারিবারিক সিন্ডিকেট। কারাগার থেকে ফিরে বারবার অপকর্মে যুক্ত হচ্ছেন এ তিন ভাই।

পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী, তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি মামলা আছে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ, জেলার হাটহাজারী ও রাউজান থানায়। তিন ভাইয়ের দলনেতা পারভেজ। শুধু তার বিরুদ্ধেই নগর ও জেলার বিভিন্ন থানায় আছে তিনটি হত্যা, ডাকাতিসহ ১১টি মামলা। সব মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে আছেন পারভেজ।

২০১৭ সালে ৩১ জুলাই অস্ত্র মামলায় পারভেজকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় চট্টগ্রামের একটি আদালত। পারভেজের ছোট ভাই এরশাদের বিরুদ্ধে রাউজান থানায় আছে দুটি অস্ত্র মামলা।

জানা গেছে, পারভেজ রাউজান থানায় ২০০৩, ২০০৪ ও ২০১৫ সালে সংঘটিত তিনটি হত্যা মামলার আসামি। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর নগরের অক্সিজেন এলাকা থেকে দুটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ পারভেজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় বশির ও মঞ্জুর নামে তার দুই সহযোগীও গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় এক বছর কারাভোগ শেষে পারভেজ জামিনে বেরিয়ে আসেন। এরপর ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন পারভেজ।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, পারভেজ পেশাদার ডাকাত। তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার চেষ্টা চলছে। শুধু পারভেজ নয়, তার দুই ভাই এরশাদ, মোরশেদও তালিকাভুক্ত অপরাধী।

জানা গেছে, চলতি বছর ২০ মার্চ রাউজান থানাধীন উরকিরচর এলাকার শেখ শফি চেয়ারম্যানের বাড়িতে একটি ডাকাতি সংঘটিত হয়। ডাকাত দল ওই বাড়ি থেকে ১৪ ভরি সোনা, নগদ টাকা লুট করে। এ ঘটনায় রাউজান থানায় ডাকাতি মামলা দায়ের হয়। এ মামলায় গত ২ এপ্রিল রোকেয়া বেগম নামে এক নারীকে এবং গত ৬ এপ্রিল সারাফত নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গ্রেপ্তার রোকেয়া বেগম গত ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিপলু কুমার দে’র আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট কচুয়ায়। তিনি এ মামলার অন্যতম আসামি ফজর আলীর স্ত্রী।

গ্রেপ্তার সারাফত গত ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জয়ন্তী রাণী রায়ের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। দুজনের জবানবন্দিতে উরকিরচরের শেখ শফি চেয়ারম্যানের বাড়িতে ডাকাতির সংঘটনের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পারভেজ হোসেনের নাম উঠে আসে। এ ঘটনায় পারভেজ ছাড়াও উঠে আসে ফজর আলী, মোক্তার, সারাফত জসিম উদ্দিনসহ ৭-৮ জনের নাম।

পারভেজ ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাউজান কদলপুর ইউনিয়নের পরীরদিঘি এলাকা থেকে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ধারালো অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনায় রাউজান থানায় পারভেজসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ৮ মে পারভেজসহ ৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

এর আগে ২০১৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাউজান থানাধীন দক্ষিণ ঢাকাখালী আবুখীল এলাকার নীলকন্ঠ মহাজনের বাড়ির পলাশ বড়ুয়ার ঘরে একটি ডাকাতি সংঘটিত হয়। সংঘবদ্ধ ডাকাতেরা তার ঘর থেকে সোনা, নগদ টাকাসহ প্রায় ৪ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় অজ্ঞাত ১৫-২০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন বাবুল নাথ। তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এতে পারভেজসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়।

এর আগে ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি দিবাগত রাতে কদলপুর নাথ পাড়ার বাবুল নাথের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা সংঘটিত হয়। সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্র বাবুল নাথের ঘর থেকে সোনাসহ প্রায় আড়াই টাকার মালামাল লুট করে। তদন্তে এ ঘটনায় পারভেজের জড়িত থাকার তথ্য পেয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

এদিকে সম্প্রতি ৩ হাজার ৬০০ ইয়াবাসহ চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন পারভেজের ছোট ভাই মোরশেদ হোসেন; এসময় রুবেল নামে তার এক সহযোগিও গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পর মোরশেদ তার দুই ভাই পারভেজ ও এরশাদের অপরাধ জগতের বিষয়ে নানা তথ্য পুলিশকে দিয়েছেন। পুলিশ এখন হন্যে হয়ে পারভেজ ও এরশাদকে খুঁজছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার এসআই আবদুল মান্নান জানান, আদালতের আদেশে মোরশেদকে তিন দিনের পুলিশ হেফাজতে আনা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দুই ভাই পারভেজ ও এরশাদের নানা অপরাধের তথ্য দিয়েছেন।

মোরশেদ পুলিশকে জানান, এক সময় তার ভাই পারভেজ ডাকাতিতে জড়িত থাকলেও এখন তিনি পুরোদস্তুর ইয়াবা কারবারি। পুলিশ তথ্য পেয়েছে, চট্টগ্রাম নগর, উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে সক্রিয় ইয়াবার একটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ এখন পারভেজের হাতে। নিজে আত্মগোপনে থাকলেও মাে. ইলিয়াস ওরফে ইলু এবং তার ভাই এরশাদকে দিয়ে ইয়াবা কারবার পরিচালনা করছেন পারভেজ।

তার সহযোগি ইলু ‘পাঠাও’ এর মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং সেবা দেয়ার আড়ালে ইয়াবার চালান নগরে, হাটহাজারী এবং রাউজানের বিভিন্ন ক্রেতার কাছে সরবরাহ করেন। ইয়াবা কারবার করে পারভেজ এখন দুটি ট্রাকের মালিক। গ্রামের বাড়িতে তৈরি করছেন বিলাসবহুল বাড়ি। আছে ২৫ লাখ টাকা দামের দামি টয়োটা প্রিমিও প্রাইভেট কার (নম্বর-চট্টমেট্রো- গ-১৩-১৯৬৩)।

পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভুঁইয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের পর মোরশেদ হোসেন তার ভাই পারভেজ ও এরশাদের ইয়াবা বেচাকেনাসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য জানিয়েছে। পারভেজের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও মারামারির ঘটনায় ১১টি মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা পারভেজ ও এরশাদকে খুঁজছি। শিগগির মোরশেদ এবং তার সহযোগি রুবেলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।