শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

২৪ জানুয়ারি গণহত্যা: যেভাবে রক্ষা পেলেন শেখ হাসিনা

প্রকাশিতঃ ২৪ জানুয়ারী ২০২১ | ১:৫৮ অপরাহ্ন


দুখু বাঙাল : ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্ত্রের মুখে হটিয়ে অবৈধভাবে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতাদখল করেই তিনি সামরিক আইন জারি করেন। ক্ষমতাদখল এবং সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদে সোচ্চার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ছাত্রসমাজ।

এরশাদের এই ক্ষমতা দখল দেশবাসী ভালোভাবে না নেওয়ায় তা রূপ নেয় গণআন্দোলনে; যা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে। জাতি এই প্রথম প্রত্যক্ষ করে চুয়ান্ন ঘণ্টা, বাহাত্তর ঘণ্টা হরতাল অবরোধের এবং আন্দোলন ঠেকাতে সান্ধ্য আইন জারির। নূর হোসেনসহ এই আন্দোলনে শহীদ হন অনেক তরুণ ও যুবক। আহত ও কারারুদ্ধ হন অসংখ্য মানুষ।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। ২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮ লালদিঘীর ময়দানে ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের পূর্বঘোষিত জনসভা। চট্টগ্রামের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও অন্যান্যকে গ্রেপ্তার করা হয় ২৪ তারিখের আগেই। পুলিশের উদ্দেশ্য ছিল জনসভা ভ-ুল করে দেওয়া। পুলিশের সকল ডিসি-ওসি এবং এসিদের সম্পৃক্ত করা হয় লালদিঘীর ময়দানের আটদলীয় জনসভার আইনশৃঙ্খলা ডিউটিতে। গোটা লালদিঘীর ময়দান ও আশপাশ এলাকায় ছিল পুলিশের নজিরবিহীন উপস্থিতি।

দুপুর অনুমান দেড়টার দিকে সামনে পেছনে হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক, জনতার ভিড়, উপরে সামিয়ানা টাঙানো একটি ট্রাকে সফরসঙ্গী নেতৃবৃন্দসহ শেখ হাসিনা কোতোয়ালী থানার মোড় পার হয়ে মিছিলসহকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছাকাছি এগুতে থাকলে পুলিশ কমিশনারের অধিকতর আস্থাভাজন পরিদর্শক জিসি ম-ল চেইন অব কমান্ড না মেনে ফোর্সের সঙ্গে মাঠে থাকা ডিসি (নর্থ) মো. মোখলেছুর রহমানসহ একাধিক সিনিয়র অফিসারকে ডিঙিয়ে তাঁর বেতারযন্ত্র থেকে সরাসরি আলফা-১ অর্থাৎ পুলিশ কমিশনারকে বলতে থাকেন ‘ওরা আসিয়া গিয়াছে স্যার’; পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা গুলি করে ‘হামাইয়া ফেল’, ‘শোয়াইয়া ফেল’ ও ‘হাসপাতাল ভরাইয়া ফেল’ বেতারে এই নির্দেশ দিতে থাকেন।

মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে কোতোয়ালী এলাকার পেট্রোল ইন্সপেক্টর গোবিন্দ চন্দ্র ম-ল তাঁর পুলিশদল নিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতি বেপরোয়া লাঠিচার্জ করতে থাকেন এবং পূর্বহুঁশিয়ারি ছাড়াই নির্বিচারে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ এবং রাইফেলের গুলি ছুড়তে থাকেন। মহিউদ্দিন শামীম, অজিত সরকার, স্বপন বিশ্বাস প্রমুখ ছাত্রনেতারা ইতিমধ্যেই পরিদর্শক জিসি ম-লের পুলিশদলের নিক্ষিপ্ত গুলিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়েই শহীদ হন। চারদিকে পুলিশের মুহুর্মূহু গুলি, টিয়ারসেল নিক্ষেপ আর লাঠিচার্জে শুরু হয়ে যায় এক ভয়াবহ এবং বিভীষিকাময় দৃশ্যের। এই দৃশ্য বিস্তৃত হতে থাকে আমতলা, নিউমার্কেট, স্টেশন রোডসহ আশপাশের সর্বত্র।

বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ট্রাকের উপর থেকে ‘আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা’ এই পরিচয় দিয়ে একটি হ্যান্ডমাইকে পুলিশের উদ্দেশে শান্তিপূর্ণ জনতার প্রতি আর গুলি না করার জন্যে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। ইতিমধ্যে এক কনস্টেবল তাঁর রাইফেল শেখ হাসিনার দিকে তাক করে তাঁকে গুলি করতে উদ্যত হলে কোতোয়ালী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক কাজী শাহাবুদ্দিন আহম্মদ ও আমি (পরিদর্শক মুহম্মদ ইছহাক দুখু, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, চান্দগাঁও থানা) বিদ্যুতবেগে তাঁর রাইফেলের নলটি ও তাঁকে ধাক্কা দিয়ে পেছনের দিকে সরিয়ে দিই।

এভাবেই সেদিন জননেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনায় বিক্ষুদ্ধ জনতা নিউমার্কেট পুলিশ বক্স, টিএ-টি ভবন, বিআরটিসি ডিপো, রাইফেল ক্লাব, পুলিশ ক্লাবসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশের কয়েকটি গাড়িসহ অনেক সরকারি মালামাল ভস্মীভূত হয়ে যায়। বিস্ফোরিত হতে থাকে হাতবোমা। বিকট শব্দে প্রকম্পিত হতে থাকে সবকিছু। অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, অ্যাডভোকেট মাজেদুল হক ও অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদসহ শতাধিক আইনজীবী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকটি ঘিরে রেখে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতিতে নিয়ে যান।

হত্যাকা-ে গণঅসন্তোষ বাড়তে থাকলে বেগতিক এরশাদ সরকার তাঁর মনোনীত বিচারপতি আমিনুর রহমান এর নেতৃত্বে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করেন। বিচারপতি আমিনুর রহমান তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন, সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ কর্তৃক গঠিত গণতদন্ত কমিটি বা সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারেনি। দিন দিন জনমনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকে যে, নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে সংঘটিত এই নারকীয় গণহত্যায় রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত রয়েছে। পরবর্তীতে এই ঘটনায় ১৯৯২ সালের মার্চ মাসের পাঁচ তারিখ চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট শহিদুল হুদা চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট চট্টগ্রামের আদালতে মির্জা রকিবুল হুদাসহ ১০০ অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যকে আসামি করে দ-বিধি আইনের ৩০২, ৩০৭, ৩২৬, ৩২৩ ও ১১৪ ধারায় মামলা করেন।

আদালতের আদেশক্রমে চট্টগ্রাম সিআইডি এই মামলা তদন্ত শেষে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা ও পরিদর্শক জিসি ম-লসহ মোট আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এই মামলা চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। দ-বিধি আইনের ৩০২/ ২০১/ ১০৯/ ৩২৬/ ৩০৭/ ১১৪/ ৩৪ ধারায় চার্জ গঠিত হলে আমি এবং কাজী শাহাবুদ্দিন আহম্মদ পরবর্তীতে ১ম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ চট্টগ্রাম জনাব আ ম ম সাঈদ-এর আদালতে ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ঘটনার বিষয় বিস্তারিত বলি। ঘটনায় ২৪ জন নিহত এবং আহত হন অসংখ্য মানুষ। সাংবাদিক, পুলিশ ও বিডিআরসহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যও আহত হন।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক জনাব ইসমাইল হোসেন ২০ জানুয়ারি ২০২০ এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। আদালত এই মামলায় শতাধিক সাক্ষীর মধ্যে শিক্ষাবিদ ড. অনুপম সেনসহ ৫৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। দাখিলকৃত অভিযোগপত্রের আটজন আসামিদের মধ্যে পাঁচজনের ফাঁসির আদেশ হয়। নিহতদের লাশ অভয়মিত্র শ্মশানঘাটে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা জিসি মন্ডল প্রথম থেকেই পলাতক আছেন। প্রধান আসামি মির্জা রকিবুল হুদা, কনস্টেবল বশির উদ্দিন ও কনস্টেবল আব্দুস সালাম রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহম্মদ, অ্যাডভোকেট স্বভুপ্রসাদ বিশ্বাস, অ্যাডভোকেট সাধনময় ভট্টাচার্য, অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হায়দার সিদ্দিকী ও অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ একদল সরকারি আইনজীবী চার্জ গঠনের প্রথম থেকে পর্যায়ক্রমে এই মামলা পরিচালনা করেন। আসামি পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট এহসানুল হক হেনা, অ্যাডভোকেট জহুরুল হক, অ্যাডভোকেট প্রবীর কুমার ধর ও এডভোকেট বিশ্বজিৎ বিশ্বাস।

এরশাদ আমলে আমি দীর্ঘ সময় সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে এবং প্রমোশনের পূর্বপর্যন্ত বেশ কয়েক মাস সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবেই কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বভার পালন করি। সিনিয়র পরিদর্শক কাজী শাহাবুদ্দিন আহম্মদ চলমান আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই আমার কাছ থেকে কোতোয়ালীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কোতোয়ালী থানায় আমার পূর্ব-অভিজ্ঞতায় ঘটনার দিন কাজী শাহাবুদ্দিন আহম্মদের সঙ্গে আমাকেও একই সেক্টরে ডিউটিতে মোতায়েন করা হয়। কোতোয়ালী থানা, লালদিঘীর ময়দান, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও চট্টগ্রাম কোর্টহিল ভৌগোলিকভাবে পাহাড় ও সমতল মিলে একই অবস্থানে পাশাপাশি অবস্থিত। এই কোর্টহিলেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা দায়রা জজ, মহানগর দায়রা জজ ও চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তর। কোতোয়ালী থানা থেকে এক দেড়শ’ গজ দূরে এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর লালকুঠি ভবন থেকে মাত্র ষাট-সত্তর গজ দূরত্বে অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ছিল সকলের কাছে বিস্ময়কর এবং অগ্রহণযোগ্য।

কাকতালীয় হলেও জীবনের বাস্তবতা হলো কাজী শাহাবুদ্দিন আহম্মদ ও আমি চাকরির মেয়াদ পূরণের আগেই স্বেচ্ছাঅবসরে আসতে বাধ্য হই। এতদিন পর জীবনের প্রথম এবং প্রিয় কর্মস্থলের এক বিভীষিকাময় ও আতঙ্কিত ঘটনার স্মৃতির সারণিতে পা রাখতে গিয়ে আমি যেন অতিক্রম করে চলেছি সেই দুর্বিষহ প্রান্তরের দৃশ্যের পর দৃশ্য, যে প্রান্তর আর উপত্যকার আলোছায়া চিরদিনের জন্যে লেপটে আছে আমার দেহ আর মনে। সেদিন চাটগাঁয়ে সারাক্ষণ কাকের কা কা ডাক ছাড়া আর কোনও পাখির কলগুঞ্জন বাজেনি আমার কানে।

লেখক : কবি ও প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা।
[চান্দগাঁও থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে অফিসিয়াল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লালদিঘী পাড়ের সেই জনসভায় আইনশৃঙ্খলাজনিত বাড়তি দায়িত্ব পালন করেছিলেন।]