শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এটা মার্ডার, ফোর্স ডেথ : আত্মহননকারী মোরশেদের স্ত্রীর অভিযোগ

প্রকাশিতঃ ১২ এপ্রিল ২০২১ | ১:২৩ পূর্বাহ্ন

মোহাম্মদ রফিক : লভ্যাংশের টাকার জন্য কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল হক রাসেল ও অন্যান্যদের ক্রমাগত মানসিক নির্যাতন ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল মোরশেদ চৌধুরীকে আত্মহননে ঠেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী।

রোববার (১১ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই অভিযোগ করেন। বলেন, ‘এটা আমার দৃষ্টিতে একটা মার্ডার। ফোর্স ডেথ। আমি আমার স্বামীর আত্মহননের নেপথ্যে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার চাই।’

এসময় আবদুল মোরশেদের মা নুরনাহার বেগম, বড় ভাই আবদুল আরশাদ চৌধুরী ও ১২ বছরের মেয়ে মোজাশ্বেরা জুম উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, গত ৭ এপ্রিল নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন হিলভিউ আবাসিক এলাকার একটি ভবনের ৬ তলায় আত্মহত্যা করেন আল-ফালাহ ব্যাংক, আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার আব্দুল মোরশেদ চৌধুরী। তিনি নগরের মাদারবাড়ির বাসিন্দা আব্দুল মৌমিন চৌধুরীর ছেলে।

মোরশেদের স্ত্রীর ইশরাত জাহান জুলি বলেন, তিন কোটি টাকার একটি পেমেন্ট ছিল, সেটি দাবি করেছিল পারভেজ ইকবাল। এটি লভ্যাংশ ছিল। এ অংক তারাই গায়ের জোরে আমার স্বামীর কাছে দাবি করেছে। কিন্তু এ টাকা আমার স্বামী দিতে পারছিল না। তিন টাকা তো না। তিন কোটি টাকা। লভ্যাংশের জন্য ওরা যে পরিমাণ মানসিক টর্চার এবং ট্রেথ করে কল দিয়েছে, ওটার জন্য আমি আজ স্বামীহারা। আমার মেয়ে বাবাহারা। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই। -বলেন ইশরাত জাহান।

মানসিক নির্যাতনে ভাইয়ের মৃত্যু
মোরশেদের বড়ভাই আরশাদ চৌধুরী বলেন, পাওনাদারদের প্রতিনিয়ত হুমকি আর চাপ আমার ভাই নিতে পারেনি। পাওনাদাররা আমার ভাইকে বিভিন্ন পর্যায়ে মানসিক নির্যাতন ও হুমকি দিয়েছেন। এসব চাপ সহ্য করতে না পেরে আমার ভাই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। যারা আমার ভাইকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই।

সুসাইড নোট
‘আর পারছি না। সত্যিই আর নিতে পারছি না। প্রতিদিন একবার করে মরছি। এই দেনার ভার আর নিতে পারছি না। তাদের হাতে পড়ে আমি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। অনেকবার চেষ্টা করেছি মরার। কিন্তু পারিনি। এই ভেবে ইনশাআল্লাহ এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারব। আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবে। আরেকটু দেখি। আরেকটু দেখি করতে করতে দেনার গর্তটা অনেক বড় হয়ে গেছে। যারা কোনও টাকাই পেত না তাদের দিতে গিয়ে এখন সত্যিকারের দেনায় জর্জরিত। বেঁচে থাকলে দেনার পরিধি বাড়বে। পরিচিত হলেও এখন চেপে ধরেছে বেশি। এ লোড সত্যিই আর নিতে পারছি না। আমি প্রতিটি ফ্যামিলি মেম্বারের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তারা অনেক বেশি অপমানিত হয়েছে। আমি ক্ষমা চাচ্ছি, আমার দ্বারা তোমরা অনেক কষ্ট পেয়েছে। জলি (স্ত্রী) প্লিজ ঝুমকে (কন্যা) দেখে রাখবা। মা-টার জন্য অনেক খারাপ লাগছে। বেচারা লাইফটাতে শুধু কষ্টই পেল। তার জন্য কিছু করতেই পারলাম না। ভাইবোন, ভাতিজি, ভাইপো সবার জন্য খুব খারাপ লাগছে। আমার এ ঘটনার জন্য ওদের উপর অনেক কথা আসবে। কিন্তু সত্যিই বলছি আমি আর পারছি না। সবাই আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও। সবাই ঝুমকে দেখে রাখবে। – আবদুল মোরশেদ চৌধুরী।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৯ মে সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, দুটি গাড়িতে করে ৮ থেকে ১০ জন যুবক ভবনে প্রবেশ করছে। ওই ভবনের ৮ তলায় বসবাস করতেন আত্মহননকারী আবদুল মোরশেদ।

মোরশেদের স্ত্রীর অভিযোগ, পাওনা টাকা পরিশোধ করার পরও ২০১৯ সালের ২৯ মে বাসায় এসে ভাঙচুর করেছিল পারভেজ ইকবাল, রিয়াজসহ আরও কয়েকজন। পারভেজ এক সময় বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিল। সেদিন লিফট ও সিঁড়ি বেয়ে ৮ তলায় আমার বাসায় এসে দরজা নক করে। সেদিন আমি আর আমার মেয়ে বাসায় একা ছিলাম। আমি দরজা খুলছিলাম না। তারা বলে, আপনার সামনে আপনার স্বামীকে ডেকে আনাব। আপনি দরজা খুলুন।’ আমি তাদের বলি, আপনারা যা ইচ্ছা তাই করেন। আমি দরজা খুলব না। এক পর্যায়ে লাথি মেরে দরজা ক্রেক করে দিয়েছে। পারভেজ ছিল। সেটা সিসিটিভির ফুটেজে আছে। ভবনের নিচে পার্ক করা গাড়িতে কোনও নেমপ্লেট ছিল না। তবে সেই গাড়িতে বসা ছিল আরশেদুল আলম বাচ্চু, নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন।

মোরশেদের স্ত্রী ইশরাত জাহানের দাবি, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসার জন্য ফুফাতে ভাই সাকিব থেকে ১২ কোটি টাকা ধার নিয়েছিল মোরশেদ। এর বিপরীতে লভ্যাংশসহ পাওনার মোট ১৮ কোটি টাকা সাকিবকে পরিশোধ করেন মোরশেদ। একইভাবে পারভেজ ইকবাল থেকে ধার নেওয়া ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিপরীতে মোরশেদ পরিশোধ করেন ১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। স্বামী মোরশেদ এবং নিজের যৌথ একাউন্ট থেকে এসব টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

স্কুলশিক্ষিকা ইশরাত জাহানের অভিযোগ, পাওনা টাকার বিপরীতে তার স্বামী লভ্যাংশ পরিশোধ করেছেন ১৩ কোটি টাকা। কিন্তু এত টাকা পরিশোধের পরও আরও লভ্যাংশের জন্য সাকিব ও পারভেজ মোরশেদকে চাপ দিতে থাকে।

‘আমার সাথে এগুলো করলে বিপদ হবে’

গত ৬ এপ্রিল লভ্যাংশের টাকা পরিশোধের জন্য মোরশেদকে ফোন করেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল হক রাসেল। টেলিফোন কথোপকথনটি তুলে ধরা হলো-

শহীদুল হক রাসেল : মোরশেদ সাহেব আমার নাম রাসেল। চিনতে পেরেছেন আমাকে?

মোরশেদ : জ্বি, জ্বি, চিনতে পেরেছি। আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন রাসেল ভাই?

শহীদুল হক রাসেল : আমার সাথে আজম (মোরশেদের ব্যবসায়ীক পার্টনার) ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। আপনার নাম্বারটা সে দিয়েছে। কালকে নাকি ডেট ছিল। আজম ভাই আজকে ডেট নিয়েছিল।

মোরশেদ : না না ভাই। আমি স্পষ্ট করে কালকের ডেট নিছি। আজ ডেট নিলে ব্যাংকিং আওয়ার নিয়ে হ্যাসেল হবে। ওনি বিজয় বসাকের (সিএমপির উপকমিশনার) অফিস থেকে আমার সাথে কথা বলেছেন। এখন বলছেন আজকে।

শহীদুল হক রাসেল : না না তার সাথে আমার কথা হয়েছে। শুনেন আমি একটা কথা বলি-বিজয় হচ্ছে পুলিশে জব করে। ও আজকে আছে এখানে, কালকে আরেক জায়গায় যাবে। পরশু দিন আরেক জায়গায় যাবে। আপনাকে চিটাগাং টাউনে থাকতে হবে। আমিও চিটাগাং টাউনেই থাকি। ওর সাথে কথা একটা বললেন। তিন চার মাস লুকাইয়া থাকলেন। আমি তো ট্রান্সফার হয়ে কোথাও যাব না। আমি চিটাগাংয়ের ছেলে চিটাগাংয়েই থাকব। আমার সাথে এগুলি করলে বিপদ হয়ে যাবে।

মোরশেদ : আমি টাকাটা দিয়ে দিছি। তারপরও এসব কথা শুনব?

শহীদুল হক রাসেল : আপনি টাকাটা কোথায় দেবেন ? আপনি ৫ তরিখ ডেট তা আপনারা নিজেরাই দিয়েছেন। মোরশেদ : না না হঠাৎ করে লকডাউন পড়ে যাবে সেটা কি আমি জানতাম?

শহীদুল হক রাসেল : আরে যেদিন টাকা দেওয়ার ডেট ছিল, লকডাউন তো ৫ তারিখে হয়েছে।

মোরশেদ : আমি সাকসেসফুলি নিয়ে আসছি। আগামীকাল ১১টার মধ্যে ঢুকে যাবে। আপনি আমাকে বেলা ১১টায় একটি কল দিয়েন। ঠিক আছে।

শহীদুল হক রাসেল : আচ্ছা ঠিক আছে।

মোরশেদ : আসসালামু আলাইকুম।

আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে মামলা
আত্মহননকারী ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মোরশেদ চৌধুরীর স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী জুলি পাঁচলাইশ থানায় গত ৮ এপ্রিল একটি মামলা দায়ের করেছেন। এমামলায় আসামি করা হয়েছে মো.পারভেজ ইকবাল (৩৬), জাবেদ ইকবাল (৪০), সৈয়দ সাকিব নাইম উদ্দিন (৩৭) ও কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা শহীদুল হক রাসেলসহ অজ্ঞাতনামা ৮/১০ জনকে।

হুমকিদাতাদের বিচার চান এমপি দিদার

এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদকে যারা হুমকি দিয়েছেন তাদের বিচার দাবি করেছেন চট্টগ্রাম -৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মো. দিদারুল আলম। এক ভিডিওবার্তায় আত্মহননকারী মোরশেদ তার স্ত্রীর আপন ভাতিজা উল্লেখ করে এমপি  দিদারুল আলম বলেন, ৮ এপ্রিল রাতে যুবলীগ নেতা শহীদুল হক রাসেল এবং পারভেজ ইকবাল মোরশেদকে হুমকি দিয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছে। আমার কাছে বিচারের জন্য বিষয়টি এসেছে। যা গন্ডগোল ছিল লভ্যাংশ নিয়ে। উভয় পক্ষের মধ্যে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা অনেক করেছি। উভয় পক্ষ যদি মিলে যেত তাহলে আজ মোরশেদকে হারাতে হতো না। হুমকিদাতা যদি আমার দলীয় লোকও হয় আমি তার রিচার চাই।’