শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কে সেই রাজাকার আবদুল হাকিম?

প্রকাশিতঃ ১৯ জুন ২০২১ | ১২:১৬ অপরাহ্ন

আবছার রাফি : ‘চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনানের প্রয়াত বাবা আবদুল হাকিম রাজাকার হওয়ায় ১৯৭২ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ’৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন।’- ফেসবুকে উক্ত অভিযোগ করেছেন আশির দশকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি অভিজিৎ ধর বাপ্পী। একই দাবি করা হচ্ছে আরও কিছু ফেসবুক পেইজ ও আইডি থেকে। এসব অভিযোগের সঙ্গে ২০১৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের করা রাজাকারের একটি তালিকা জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ওই তালিকার ২৭ নম্বরে আবদুল হাকিম নামের একজনের নাম আছে; তার বিরুদ্ধে আনোয়ারা থানায় ১১(১)১৯৭২- এ নম্বরের মামলা আছে বলেও উল্লেখ করা হয়।

এদিকে অভিজিৎ ধর বাপ্পীসহ যারা এই আবদুল হাকিম রাজাকারকে আওয়ামী লীগ নেতা শফিক আদনানের বাবা বলে দাবি করছেন- তাদের দাবি, ‘রাজাকার আবদুল হাকিমের বাবার নাম হাজী আমির আলী। তারা তৎকালীন আনোয়ারা থানার ‘কালার পোল থৈ গ্রামের’ বাসিন্দা।” যদিও আনোয়ারায় ‘কালার পোল থৈ গ্রাম’ নামের কোনও এলাকা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তাহলে কে সেই রাজাকার আবদুল হাকিম? জানতে চাওয়া হয় আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জুবায়ের আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, ‘আনোয়ারা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মান্নান তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানিয়েছেন, আনোয়ারার উসখাইনে আবদুল হাকিম নামের একজন রাজাকার ছিলেন। তার বাবার নাম মোশাররফ আলী।’

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আনোয়ারা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন ইউএনও। এরপর জানতে চাওয়া হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান একুশে পত্রিকাকে বলেন, “পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওসখাইন গ্রামে আবদুল হাকিম নামে একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। তার বাবার নাম মোশাররফ আলী। তিনি ১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হন। আনোয়ারায় আবদুল হাকিম নামে ওই একজনই রাজাকার ছিলেন।”

তাহলে এখন দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেল। অভিজিৎ ধর বাপ্পীসহ একটি পক্ষের দাবি, রাজাকার আবদুল হাকিমের বাবার নাম হাজী আমির আলী। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও ইউএনও বলছেন, রাজাকার আবদুল হাকিমের বাবার নাম মোশাররফ আলী।

এদিকে এশিয়াটিক সোসাইটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন’ প্রকল্পের গবেষক জামাল উদ্দিন সম্পাদিত ‘আনোয়ারা : একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থের ১৪৩ নং পৃষ্ঠায় ‘ওসখাইন গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন, রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিম নিহত’ শিরোনামে একটি লেখা আছে।

সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সুবেদার আবু ইসলামের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ওসখাইন গ্রামস্থ রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিমের বাড়িতে অপারেশন চালায়। ঐ দিন আবদুল হাকিমের মেয়ের বিয়ের জোড়া (পান-চিনি) উপলক্ষে খানার আয়োজন চলছিল। মুক্তিযোদ্ধারা গোপন সূত্রে এই আয়োজনের খবর পেয়ে আবদুল হাকিমের টর্চারসেল নামক বাড়িটিতে আক্রমণ করে। সুবেদার আবু ইসলামের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার দলটি সাধারণ যাত্রীদের বেশ ধরে লঞ্চযোগে দুপুরের দিকে ওসখাইন ঘাটে পৌঁছে। ঘাটে নেমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় দেড় মাইল পথ পায়ে হেঁটে চতুর্দিক থেকে রাজাকার আবদুল হাকিমের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যেকের মাথা সাদা রুমালে বাঁধা, গায়ে সাদা গেঞ্জি, পরনে হাফ প্যান্ট। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাড়িটি ঘিরে ফেলে তখন আগত অতিথিদের খাওয়ার আয়োজন চলছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আগত অতিথিদের বলেন, কেউ নড়াচড়া করবেন না, যে যেখানে আছেন- সেখানেই থাকুন। আমরা যে কাজে এসেছি তা শেষ করে চলে যাব।

এমন সময় রাজাকার আবদুল হাকিমের সহযোগী রাজাকার শাহ আলম মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি চালায়। এ ঘটনায় চারজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা গুলি চালালে তিনজন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হন। এমন সময় রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিম পিস্তল হাতে বাড়ির পেছনে কচুরিপানার ডোবায় লাফ দিয়ে লুকানোর চেষ্টা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বাড়ির পেছনে খোঁজাখুঁজি করছিলো, ঠিক ঐ সময় তার পাশের বাড়ির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সমর্থিত একমাত্র পরিবারের ষোড়শীকন্যা আনোয়ারা বেগম বুলু ফেনার ডোবায় লুকানোর কথা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ফাঁস করে দেয়। সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা ঐ ফেনার ডোবা থেকে আবদুল হাকিমকে উঠে আসতে নির্দেশ দেয়। সে নিজের রিভলভার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়। এক পর্যায়ে তার গুলি শেষ হয়ে যায়। তা বুঝতে পেরে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ফেনার ডোবা থেকে উঠে আসতে নির্দেশ দিলে সে উঠে আসে।

এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাকে দু’হাত উপরে তুলে সারেন্ডার করতে বললে- সে প্রতিউত্তরে জবাব দেয়- আমি অনেকদিন আগেই কলমা পড়ে রেখেছি, আপনারা যে কাজ করতে এসেছেন তা করে চলে যান। এ কথা বলার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তার কপাল লক্ষ করে এক রাউন্ড গুলি চালায়- তাতে মাথায় সে সামান্য আহত হয়। পুনরায় মুক্তিযোদ্ধারা তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে সে একই জবাব দেয়। আর দেরি না করে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল হাকিমের বুক লক্ষ্য করে আরেক রাউন্ড গুলি করলে সে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।’

তাহলে এখন পর্যন্ত তিন ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেল। প্রথমত, সাবেক ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্য অনুযায়ী, আবদুল হাকিম যুদ্ধের সময় মারা যাননি, তিনি ‘৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি’ ছিলেন। দ্বিতীয়ত, আনোয়ারা উপজেলা কমান্ডার আবদুল মান্নানের বক্তব্য অনুযায়ী, সেই রাজাকার আবদুল হাকিম ‘১৯৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে’ মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হন। তৃতীয়ত, জামাল উদ্দিন সম্পাদিত ‘আনোয়ারা : একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর’ সুবেদার আবু ইসলামের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ওসখাইন গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিমকে হত্যা করে।

এই তিন ধরনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রকৃত ঘটনা জানতে চেষ্টা করে একুশে পত্রিকা। এরই অংশ হিসেবে আনোয়ারার পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওসখাইন এলাকায় গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয় রাজাকার আবদুল হাকিমের পরিবার সম্পর্কে। জানতে চাইলে পরৈকোড়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার নুরুল আজিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি আবদুল হাকিম নামের একজন রাজাকার ছিল। তখন আমরা ছোট ছিলাম। তবে আমার বাপ-দাদার মুখে শুনেছি তার কথা। তাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলেছিল। এসব কথা এলাকার সবাই জানে। রাজাকার আবদুল হাকিমের দুই সন্তান ছিল। একজনের নাম আবুল ফজল, তার এক ছেলে এখন বিদেশ থাকে। হাকিমের ছেলে অন্যজনের নাম আলম শাহ, তিনি নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় থাকেন।’ ওসখাইন এলাকায় চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা শফিক আদনানের গ্রামের বাড়ি নয় বলেও জানান মেম্বার নুরুল আজিম।

অন্যদিকে একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বইয়ের ১৪৬ নং পৃষ্ঠায় ‘আবদুল হাকিম ও তার টর্চার সেল : সে এক ভয়ঙ্কর ইতিহাস’- শিরোনামে প্রকাশিত লেখায় উল্লেখ আছে, রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিমের বিশাল রাজাকারবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অত্যন্ত দুর্ধর্ষ কয়েকজনের নাম; এরা হলেন- রাজাকার নুরুল হক (আবদুল হাকিমের ভাই) পিতা মোশাররফ আলী, রাজাকার আবুল কালাম (আলম শাহ) পিতা রাজাকার আবদুল হাকিম, রাজাকার আবুল ফজল পিতা রাজাকার আবদুল হাকিম।’

পরৈকোড়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার নুরুল আজিমের বক্তব্যের সঙ্গে জামাল উদ্দিনের বইয়ের লেখার মিল পাওয়া গেছে। মেম্বার নুরুল আজিম বলেছেন, আলম শাহ ও আবুল ফজল নামের দুইজন ছেলে আছে আবদুল হাকিমের। অন্যদিকে জামাল উদ্দিনও দাবি করেছেন, আলম শাহ ও আবুল ফজল নামে রাজাকার আবদুল হাকিমের দুই ছেলে ছিল। এরমধ্যে আলম শাহ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার সহযোগী ছিলেন বলে জামাল উদ্দিন দাবি করেন। এছাড়া আবদুল হাকিমের ভাই নুরুল হকের বাবার নাম যে মোশাররফ আলী সেটিও জামাল উদ্দিনের বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব মিল পাওয়ার পর বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখতে আমরা ফিরে যেতে চাই সেই মূল জায়গায়- ২০১৯ সালে প্রকাশ করা রাজাকারের তালিকাটিতে, যেখানে রাজাকার আবদুল হাকিমের নামের পাশে একটি মামলার নম্বরও লেখা হয়েছিল। সেই মামলার নথি ১৯৭২ সালের হওয়ায় আনোয়ারা থানা ও চট্টগ্রামের আদালতে খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায়নি। তাহলে মামলার নম্বরটি রাজাকার তালিকায় যুক্ত হয়েছে কীভাবে?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ-প্রথম পর্ব’ শিরোনামে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের এই তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, জীবনবাজি রেখে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকের নামও এ তালিকায় রয়েছে। আবার কুখ্যাত অনেক রাজাকারের নাম নেই এ তালিকায়। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

এরপর ২১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, দালাল আইনে মামলা থাকা ব্যক্তিদের নাম রাজাকারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারের লিস্ট করবে। আমাদের কাছে তারা চিঠি পাঠিয়েছিল, আমাদের কাছে যে সমস্ত তথ্য আছে সেগুলো যেন পাঠানো হয়। রাজাকারের লিস্ট তৈরি করা দুরূহ ব্যাপার। আমরা প্রাথমিকভাবে দালাল আইনে যাদের নামে মামলা হয়েছিল, সেই দালাল আইনের লিস্টটা পাঠিয়েছি। সেই লিস্টে আমরা মন্তব্য করে দিয়েছি, অনেকের নামের মামলা উইথড্র করা হয়েছিল। সেটা তালিকায় যথাযথভাবে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রাজাকারের তালিকা আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত হবে।’

এভাবে বক্তব্য দিয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল নিবিড়ভাবে যাচাই-বাছাই করে পূর্ণাঙ্গ রাজাকারদের তালিকা তৈরি করতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরদিন ২২ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা স্থগিত করা হয়। জানানো হয়, যাচাই-বাছাই করে পরে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেই তালিকাটি আর প্রকাশ হয়নি। সেই রাজাকার তালিকার বরাত দিয়ে সম্প্রতি ফেসবুকে অভিযোগ করা হচ্ছে, আনোয়ারার ওসখাইন গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাকিমই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা শফিক আদনানের বাবা।

এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করতে ১৮ জুন (শুক্রবার) দুপুরে শফিক আদনানের গ্রামের বাড়ি শিকলবাহা (আগে পটিয়া থানাভুক্ত, বর্তমানে কর্ণফুলী থানা) এলাকায় যান একুশে পত্রিকার একজন প্রতিবেদক। এ সময় আবদুস সোবহান (৬০) নামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আবদুল হাকিম পরিবার খানদানি আওয়ামী লীগ। তবে উনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিনা জানি না। যা জানি না তা বলে লাভ নেই। আমার বুদ্ধিবয়স থেকে হাকিম সাহেব আওয়ামী লীগ করতেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। শুধু তিনি নন, হাজীবাড়ীতে কোনো রাজাকারই নেই।’

৬৮ বছর বয়সী স্থানীয় আরেক বাসিন্দা শামছুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে যুদ্ধের সময় আমি এ কে খানে চাকরি করতাম। শেখ সাহেবের সাথে আন্দোলন করেছি, আমরা অস্ত্র কাঁধে নিয়েছি। ওনি (আবদুল হাকিম) রাজাকার ছিলেন না। এটা অবিশ্বাস্য কথা একেবারে। দক্ষিণ জেলায় আওয়ামী লীগ থাকলে তারমধ্যে তারা অন্যতম। আমি খুব ভালোভাবে চিনি আবদুল হাকিম সাহেবকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ফিরিঙ্গিবাজারে ব্যবসা করতেন, সেখানে তাদের ব্যবসা ছিলো।’

এদিকে গত ৪ জুন ফেসবুকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অভিজিৎ ধর বাপ্পী লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ এতই কি এতিম! কুখ্যাত সাজাপ্রাপ্ত আবদুল হাকিম রাজাকারের পুত্রও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে চায়।”

ফেসবুকে প্রচারিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার বাবার নাম আবদুল হাকিম। দাদার নাম আমীর আলী। অন্যদিকে রাজাকার আবদুল হাকিমের বাবার নাম মোশাররফ আলী। রাজাকার হাকিমের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওসখাইনে। অন্যদিকে আমার বাবা ১৯৪৭ সালে বিয়ের পূর্বে তৎকালীন পটিয়া থানাধীন শিকলবাহা গ্রাম থেকে নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন ৬৯, ফিরিঙ্গিবাজার ঠিকানায় চলে আসেন। সেখানে তিনি দিলোয়ারা কেমিক্যাল নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যে প্রতিষ্ঠানে দিলোয়ারা কেশ তৈল, কসকো সাবান, সেমাই ইত্যাদি তৈরি হতো। এবং ২০০০ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি মারা যান। মৃত্যুর পরদিন চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকায় শোক সংবাদও ছাপানো হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, মৃত্যুকালে তিনি ৪ পুত্র ও ৪ কন্যাসহ রেখে যাবার কথা। এবং শেষে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক শফিক আদনান মরহুমের তৃতীয় পুত্র।’

তিনি বলেন, ‘রাজাকার তালিকায় যে আবদুল হাকিমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তার বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওসখাইনে। সেই রাজাকার আবদুল হাকিমের এক ছেলের নাম শাহ আলম বলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন। অন্যদিকে আমার বাবা আবদুল হাকিমের প্রথম ছেলের নাম অ্যাডভোকেট এম ওয়াদুদ, দ্বিতীয় ছেলের নাম এস এম জামাল উদ্দিন বাবুল, তৃতীয় আমি, চতুর্থ ছেলের নাম রেজাউল্লাহ খোকন। রাজাকার হাকিমের নামের সঙ্গে আমার বাবার নাম মিল থাকায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

শফিক আদনানের দাবি, আশৈশব থেকে আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত তিনি। ’৭৫ পরবর্তী প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মীও ছিলেন। ১৯৭৫ সালে ৮ম শ্রেণিতে থাকাকালীন সরকারি মুসলিম উচ্চবিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন শফিক আদনান। ১৯৮১-১৯৮২ সাল পর্যন্ত ৩৩ নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সভাপতি ছিলেন।

১৯৮৪ সালে মহানগর ছাত্রলীগের রফিকুল ইসলাম বাচ্চু ও গোলাম মোস্তফা বাচ্চু কমিটির (৩৭ সদস্য বিশিষ্ট) কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন শফিক আদনান। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত মহানগর যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক। ২০০৪ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। ২০০৬ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক। এর আগে ২০০৩ সালের জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মীর্জা আজমের কেন্দ্রীয় যুবলীগ কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য। ২০১৩ সাল থেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন শফিক আদনান।

শফিক আদনানের বড় ভাই অ্যাডভোকেট এম ওয়াদুদ (কবি ও সাংস্কৃতিককর্মী হিসেবে তখন শ্যামল অদুদ হিসাবে পরিচিত) আওয়ামী লীগ পন্থী সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সময় পাকবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে অকথ্য নির্যাতনের স্বীকার হন বলে শফিক আদনান জানিয়েছেন। অ্যাডভোকেট এম ওয়াদুদ ছাত্রলীগ কর্তৃক মনোনীত চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ১৯৭২-৭৩ সালে মাহবুব-নাছির পরিষদ হতে এজিএস প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন এবং ৭ বা ৯ ভোটে হেরে যান বলেও জানান তিনি।

শফিক আদনান বলেন, ‘আমার মেজ ভাই এসএম জামাল উদ্দিন বাবুল ’৭৫ পরবর্তী প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তার সম্পাদনায় জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ১৯৭৮, ’৭৯, ’৮০ সালে ‘লক্ষ মুজিবের কণ্ঠে’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের হয়, ওইসময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়াও দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন এবং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মেজ ভাই এসএম জামালের অনুপ্রেরণায় আমি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছি। আমার ছোট ভাই রেজাউল্লাহ খোকন বড় ভাইদের অনুপ্রেরণায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। সে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।’

শফিক আদনান বলেন, ‘আমি ছাত্রজীবনে ওতপ্রোতভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে আমার প্রয়াত বাবা আব্দুল হাকিমের ফিরিঙ্গিবাজারের বাড়ি থেকেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হত। ১৯৮৭ সালের ১৯ নভেম্বর উক্ত বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আমি ছাড়াও শফিকুল হাসান ও কমল দাস আহত হন। এই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলায় আসামি করা হয় আমার প্রয়াত বাবা আবদুল হাকিম, ভাই এম রেজাউল্লাহ খোকন ও এসএম জামাল উদ্দিন বাবুল, আমাকে ও শফিকুল হাসানকে। এই মামলায় এম রেজাউল্লাহ খোকনকে গ্রেপ্তার করে তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় এবং তাকে ৬ মাস কারাভোগ করতে হয়। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী যুবলীগের সদস্য এবং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক।’

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত শফিক আদনান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সামনে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। তাই হয়তো কেউ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আমাকে হেয় করতে এই ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই ধরনের ষড়যন্ত্র কখনোই সফল হবে না।’

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন একুশে পত্রিকার আনোয়ারা প্রতিনিধি জিন্নাত আয়ুব]