শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

দেশগঠনের কারিগরদের আর কত হেনস্তা, হয়রানি বিমানবন্দরে !

প্রকাশিতঃ ১৮ এপ্রিল ২০১৭ | ১:০৬ পূর্বাহ্ন

নুর মোহাম্মদ নুর, কাতার : জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান মতে, ২০১৬ সালে সাড়ে সাত লক্ষাধিক বাংলাদেশি ‘বিদেশ’ নামের সোনার হরিণের আশায় দেশ ছেড়েছে। অভিবাসীদের গন্তব্যস্থল পৃথিবীর বিভিন্ন অভিমুখে হলেও বরাবরের মত মধ্যপ্রাচ্যেই এসেছে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী। ২০১৬ সালে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য যাওয়া ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন অভিবাসীর মধ্যে ৮০ দশমিক ৮২ শতাংশ এসেছে ভূমধ্যসাগরীয় সাহারা মরুভূমি ও উপসাগর সহযোগী সংস্থাভুক্ত দেশগুলোতে।

পরিসংখ্যানটি আরও একটু ভারি হতে পারতো। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ইতিমধ্যে প্রভাব পড়েছে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক জীবনব্যবস্থায়। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, তিউনিসিয়ার জাইন আল-আবিদিন বিন আলি, মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি আর ইয়েমেনের আলি আব্দুল্লাহ সালেহ শাসন যুগের অবসানের পর যুদ্ধরত সিরিয়া আর ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার (আইসিস) অব্যাহত বিবাদ, বিশ্ববাজারে তেলের দাম আশাতীত হৃাস পাওয়া এবং সর্বশেষ মার্কিন প্রশাসনে রদবদল- সব মিলিয়ে তেল রপ্তানিনির্ভর দেশগুলোর উন্নয়নের সূচক আপাতত যে উর্ধ্বমুখী হচ্ছে না, তা সহজে বোঝা যাচ্ছে।

অন্যদিকে ২০১৩-১৪ জাতীয় অর্থবছরে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ১৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন, যা অর্থবছর ২০১৪-১৫ তে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়নে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নেতিবাচক প্রবাহে সেই সংখ্যা ১৪ দশমিক ৯৩ বিলিয়নে চলে আসে। অব্যাহত নেতিবাচক প্রবাহের ফলে চলতি অর্থবছর (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত প্রবাসীরা সর্বমোট রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ৮ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গত আট মাসে রেমিটেন্স কমেছে ১৭ শতাংশ, ধারণা করা হচ্ছে বছর সমাপ্তির পূর্বে গড় প্রবাহ হিসেবে গত বছরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকবে এই বছরের প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর সংখ্যা। অন্তর্মুখী বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যায় বেশি হলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত নিম্মগতির পেছনে যে কারণগুলো অন্যতম- তার মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা প্রেরণ, বিকাশে টাকা পাঠানো, প্রবাসে অদক্ষ শ্রমিকদের বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে আধুনিক ডিজিটাল যুগেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দ্রুত অর্থ স্থানান্তরের সুবিধা-সুযোগ গ্রামপর্যায়ে অপ্রতুল, অথচ বেশিরভাগ প্রবাসীরা কিন্তু গ্রাম থেকে আসা।

দূরপ্রাচ্য, পূর্ব ও পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য বসবাসরত প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর শেয়ার ৬০ শতাংশের উপরে অথচ এই মানুষগুলো সবচেয়ে অনাহুত। মধ্যপ্রাচ্যে আসা প্রবাসীরা তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দিগন্তের প্রবাসীদের তুলনায় কম শিক্ষিত, দক্ষ ও আড়ম্বর কিন্তু এসব মানুষের ঘামে অর্জিত সামগ্রিক প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের ৬০ শতাংশ এসে জমা হয় জাতীয় কোষাগারে। হোক না তারা স্বল্পশিক্ষিত, অদক্ষ, অনাড়ম্বর কিন্তু তাঁদের একাগ্রতা, সাফল্য, পরিশ্রম আর সততার গল্পগুলো অনেক শ্রুতিমধুর।

সরকারের নীতিনির্ধারণী ও উচ্চমহল থেকে প্রবাসীদের “সোনার ছেলে”, “রেমিট্যান্স সৈনিক”, প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় সচল বাংলাদেশের অর্থনীতি কিংবা প্রত্যেক প্রবাসীরা বাংলাদেশের একেকজন রাষ্ট্রদূত ইত্যাদি মুখরোচক বিশেষণের সমাহারে প্রবাসীদের আপাত খুশি করলেও মূলত প্রবাসীদের সমস্যাগুলোর প্রতি নজর দেয়ার কেউ নেই। নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নতুবা একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলা প্রবাসী যদি দেশে যায় তাহলে তাঁদের সাথে আনা লাগেজ, মালামালগুলো স্ক্যানারে অমানবিকভাবে উঠানামা তাদেরই করতে হয়, যা অত্যন্ত নির্দয় ও অসভ্যতার সামিল।

কর্তৃপক্ষের উচিত এসব স্ক্যানারের উভয়দিকে ন্যূনতম দুই জন লোক নিয়োগ করা যাদের কাজ হবে সমস্ত প্রবাসীদের লাগেজ, মালামাল ট্রলি থেকে স্ক্যানারে উঠানামা করা। দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অভ্যন্তরে অভিবাসন/অভিপ্রয়াণ জোনে কাউন্টার বৃদ্ধি করতে হবে যাতে যাত্রীদের যাওয়া আসার ক্ষেত্রে অমানবিকভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। বয়োজ্যেষ্ঠ ও মহিলাদের জন্য আলাদা কাউন্টার থাকা নিতান্ত আবশ্যক।

“ভ্রমণ কর” নামে একটি সারচার্জ সম্পৃক্ত করা হয় প্রতিটি কাজের সন্ধানে আসা প্রবাসীর টিকেটের সাথে। এমন শুভঙ্করের ফাঁকি চলছে গোড়ার দিক থেকে, কিন্তু দেখার কেউ নেই। সরকার কি জানে না প্রবাসীরা ভ্রমণ করতে আসে না বরঞ্চ শ্রম দিয়ে পেট্রোডলার উপহার দিচ্ছে দেশকে; তবুও আমাদের “ভ্রমণ কর” দিতে হচ্ছে, অবশ্য ভিজিট ভিসায় যারা আসে তাঁদের কথা ভিন্ন।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে মিতব্যয়ী এয়ারলাইন্সে আসা যাত্রী আর ইউরোপ কিংবা পশ্চিমা দেশ থেকে উড়ে আসা এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের সাথে এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আচরণগত বৈষম্যের একটি অশোভন পর্দা সরাতে হবে। সবাইকে অবনত-মস্তিষ্কে স্বীকার করতেই হবে এসব অজপাড়া গাঁ থেকে আসা মানুষেরাই ৫০ ডিগ্রী আর্দ্রতায় অগ্নিশিখার ঘামধারায় অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় উষ্ণ রাখে আমাদের রিজার্ভের ভোল্টকে; তাই তাঁদের অনাদর নয়, জানাতে হবে অভিবাদন, সম্মান; একজন গর্বিত সন্তান হিসেবে, দেশগড়ার কারিগর হিসেবে।

আমাদের এশিয়া মহাদেশের একটি দেশ ফিলিপাইন। আমাদের মত রেমিট্যান্স নির্ভর একটি দেশ এবং বিশ্বে শীর্ষ রেমিট্যান্স গ্রহীতার দিক দিয়ে তৃতীয়। সেই দেশের প্রতিটি প্রবাসীকে একটি গোলাপ দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বিমানবন্দরে এতে প্রবাসীরা পুলকিত শুধু নয়, ফিলিপাইনে ফুল ব্যবসায় এসেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
রেমিট্যান্স সেক্টরকে শিল্পায়নে প্রতিষ্ঠা করতে হলে বাড়াতে হবে প্রবাসীদের আস্থা, বিশ্বাস আর কদর। তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রবাসীদের সাথে শুধু রেমিট্যান্সের সম্পর্ক নয়, যে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা রয়েছেন সেদেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের পণ্য, বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিরাও হচ্ছে সেসব পণ্যের ভোক্তা। একই সাথে ব্র্যান্ডিং হচ্ছে আমাদের পণ্য, শিল্প, সাহিত্য আর মানচিত্রের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপের প্রতিবেদন “The Survey on Investment from Remittance 2016” এ দেখানো হয়েছে প্রবাসীদের আয়ের ২২ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে অবৈধ পথে অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে। অবৈধ পথে, হুন্ডির মাধ্যমে বা বিদেশ থেকে বিকাশে আসা এই ২২ শতাংশ মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হলে সচেতন করতে হবে প্রবাসীদের। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রধান তিন স্তম্ভ পোশাকশিল্প, রেমিট্যান্স ও কৃষি। পোশাকশিল্পের পরের স্থান প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থ বা রেমিট্যান্সের। পোশাক শিল্পে আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা অনেকটাই আবার বিদেশে চলে যায় তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং আনুষঙ্গিক উপকরণ আমদানিতে।

কিন্তু রেমিট্যান্স এমন একটা খাত যেখানে কোনো উপকরণের জন্য অর্জিত অর্থ আবার বিদেশে চলে যায় না। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে প্রবাসীদের পাঠানো “বৈদেশিক মুদ্রা”র মত একটা নির্ভরশীল খাতকে শক্তিশালী এবং ফলপ্রসূ করতে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে প্রবাসীদের সমস্যা, হয়রানি আর সুযোগ-সুবিধার প্রতি।
নুর মোহাম্মদ নুর : কাতার প্রবাসী, প্রাবন্ধিক,