বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কসূত্র

প্রকাশিতঃ ৩ অক্টোবর ২০২১ | ২:১৬ অপরাহ্ন

শান্তনু চৌধুরী : চাণক্যের শ্লোক বা অর্থশাস্ত্র নিয়ে তাঁর কথা আমরা কমবেশি জানি। শত শত বছর আগে বলা সেই কথাগুলো আজও যেন প্রাসঙ্গিক। তাঁর একটি শ্লোক এমন- ‘উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে শত্রুবিগ্রহে। রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ’। অর্থাৎ যে ব্যক্তি উৎসবের সময়, বিপদের সময়, দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে, শক্রুর সঙ্গে যুদ্ধ হলে, বিচারালয়ে এবং শ্মশানে সর্বদাই সহায় হন তিনিই প্রকৃত বন্ধু। তিনি আরো একটি শ্লোকে এমনটি বলেছেন, দুজন মানুষকে কখনো না ভুলতে। যিনি বিপদের সময় পাশে ছিলেন আর যিনি ছিলেন না।

প্রকৃতপক্ষে সময় বদলেছে। বদলেছে সম্পর্কের সূত্রগুলো। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ কথাটা এমনি এমনি আসেনি। সত্যিই কি আগের মানুষ সুন্দর দিন কাটাতেন? আসলে রকমফের সবসময়ই রয়েছে। তবে এতো সাম্প্রদায়িকতা, এতো উগ্রতা বা এতো ধর্মান্ধতা আগে ছিল না। জীবনের কতো ঘটনাইতো মনে পড়ে। আমার কাকা ছিলেন নৌবাহিনীতে। একবার চট্টগ্রামের বন্দরটিলায় সাধারণ মানুষের সাথে নৌবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সে সময় কাকা ছিলেন জাহাজে সাগরে। আর কাকীমা বন্দরটিলা এলাকার বাসায়। সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারতেন তিনি নৌবাহিনীর বউ তাহলে হয়ত নির্যাতন করতেন। সেখান থেকে কাকার এক বন্ধু জীবনবাজি রেখে নিজের বউ পরিচয় দিয়ে উদ্ধার করেছিলেন বন্ধুর বউকে।

এই ঘটনাটি এ কারণে বললাম এখন স্বার্থান্ধ আর বিষয় বস্তুই যেন সস্পর্কের ভিত্তি গড়ে দেয়। কার গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, কোন হোটেলে খায়, কোথায় ঘুরতে যান বা ক্ষমতা কতোটুকু, কোন পদে আছেন এসবই নির্ভর করছে অন্যপক্ষ কতোটা বন্ধুত্ব করবে আপনার সাথে।

অথচ সবাই আমরা ভুলে যাই যে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। অবশ্য সবসময় এসব যে ছিল না তা নয়। এই যেমন মহাভারতের কথা যদি বলি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ থেকে দ্বৈপায়ন হৃদে পালালেন দুর্যোধন। কিন্তু ব্যাধের মাধ্যমে খবর গেল পা-বদের কাছে। পশুশিকারি ব্যাধের কাছ থেকে অমূল্য খবর পেয়ে পা-বরা সদলবলে কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন দ্বৈপায়ন হৃদে। চারদিকে বিপুল শব্দ হচ্ছে। হঠাৎই নির্জন বনস্থলীতে রথের ঘর্ঘর, শঙ্খনাদ, রণহুংকার-দ্বৈপায়ন হৃদের পরিবেশ আকুল হয়ে উঠল। দুর্যোধন যখন পরিস্কার বুঝতে পারছেন কিছূ একটা ঘটতে চলেছে, কেননা জলের মধ্য থেকেও তিনি মেঘগর্জন সদৃশ তুমুল শব্দ শুনতে পারছেন। ঠিক এই সময় অশ্বত্থামা, কৃপ, কৃতবর্মারা দুর্যোধনকে বললেন, মহারাজ! বিজয় ভাবনায় উদ্ধৃত হয়ে পা-বরা মহানন্দে এই দিকে ধেয়ে আসছে, অতএব অনুমতি করুন, এবার আমরা এখান থেকে চলে যাই।

এই বিষয়টা কেমন যেন! এরা এতোবড় যোদ্ধা, মারণাস্ত্রের অধিকারী এবং একটু আগেই যুদ্ধ করার জন্য দুর্যোধনকে উসকানি দিচ্ছিলেন সেই তারাই বিপদের সময় তাঁকে একা রেখে পালাচ্ছেন। জীবনটা আসলে এমনই। জীবনের দুঃসময়ে কারো একটু সাহস, একটু কথা বা মনে করেন কারো যদি উপকার করার ইচ্ছে থাকে সে সুযোগতো রয়েছেই, কিন্তু কেই বা এগিয়ে আসে। বরং বিপদগ্রস্ততে বিষাদে ঠেলে দিয়ে অনেকে আনন্দ পান। উপরে উপরে হয়তো সান্ত¡নার ভান ধরেন। কিন্তু মনে মনে খুশি হন। কারণ অপরের ব্যর্থতা বা কষ্ট উদযাপনই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সম্পর্কের কথা যখন উঠল মহাভারতের আরো একটি সম্পর্কের কথা এখানে বলা যেতে পারে।

ভারতীয় পরম্পরায় প্রেমের পরমতম উদাহরণ শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধার প্রেম। যুগে যুগে কালে কালে উদাহরণ হয়ে থেকেছে এই ভালোবাসা। ভারতীয় পরম্পরায় প্রেমের স্বাভাবিক পরিণতি হল বিবাহ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, এই চিরায়ত যুগলই কিন্তু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন আসে, কেন শ্রীরাধাকে বিবাহ করেননি পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ?

মনে রাখা প্রয়োজন, ‘মহাভারত’-এ কোথাও শ্রীরাধার উল্লেখ নেই। সেখানে কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মীনি, সত্যভামা প্রমুখ। কিন্তু কদাপি উল্লি­খিত নন শ্রীরাধা। শশীভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর মহাগ্রন্থ ‘শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ’-এ স্পষ্টতই দেখিয়েছেন, শ্রীরাধা নামের চরিত্রটি একান্তভাবেই পরবর্তী কালের বৈষ্ণব সাহিত্যকারদের অবদান। মহাভারত-এ তিনি অনুপস্থিত। শশীভূষণবাবুর মতে, এই চরিত্র আসলে এমন এক নির্মাণ, যার পিছনে কাজ করছে কয়েক হাজার বছরের দর্শন-ভাবনা।

আবার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধনের যে কথা বলেছিলাম সেটাও দেখা যাচ্ছে যুগে যুগে রয়েছে। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ থেকে যদি উদাহরণ দেই। তিনি লিখেছেন, ‘ওহে ধার্মিকবর! আমি ও-সকল কথা অনেক জানি। টাকা যে জিনিস, তাহাও ভাল করিয়া চিনি। মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া থাকেন; কিন্তু জগৎ এমনই ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই, সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই, ভ্রাতা-ভগ্নীর নিকট কথাটার প্রত্যাশা নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে, বল তো জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালবাসারও আশা নাই; কাহারো নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা। জগতে টাকারই খেলা। টাকা যে কী পদার্থ, তাহা তুমি চেন বা না চেন, আমি বেশ চিনি। আর তুমি নিশ্চয় জানিয়ো, আমি নেহাত মূর্খ নহি, আপন লাভালাভ বেশ বুঝিতে পারি’।

বৈষ্ণব দর্শন মতে, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা পূর্ণব্রহ্মস্বরপ। তাঁরা এক অখ- সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধনে তাঁদের যুগলকে ভাবাই সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে যখন শ্রীকৃষ্ণের কল্পনা পূর্ণাবয়ব পায়, তখন তাতে মিশ্রিত হয় মহাভারত, ভাগবত, গীতা ও বিভিন্ন পুরাণ থেকে আহরিত তথ্য। সব মিলিয়ে কৃষ্ণকে পুরুষোত্তম হিসেবে কল্পনা করা হতে থাকে। এই বিন্দু থেকে গীতায় উক্ত উবাচ— ‘শ্রীকৃষ্ণই যাবতীয় প্রেমভাবনার আধার’-কে বিচার করলে বোঝা যায়, শ্রীরাধার তরফ থেকে আলাদা করে ‘প্রেম’ বলে কিছু হতে পারে না। তাঁর চৈতন্য সম্পূর্ণতই কৃষ্ণময়। সেখানে লৌকিক বিবাহের কোনও প্রয়োজন নেই। এটাও সম্পর্কের আরেক রূপ।

আবার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধনের যে কথা বলেছিলাম সেটাও দেখা যাচ্ছে যুগে যুগে রয়েছে। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ থেকে যদি উদাহরণ দেই। তিনি লিখেছেন, ‘ওহে ধার্মিকবর! আমি ও-সকল কথা অনেক জানি। টাকা যে জিনিস, তাহাও ভাল করিয়া চিনি। মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া থাকেন; কিন্তু জগৎ এমনই ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই, সমাজে নাই, স্বজাতির নিকটে নাই, ভ্রাতা-ভগ্নীর নিকট কথাটার প্রত্যাশা নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে, বল তো জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালবাসারও আশা নাই; কাহারো নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা। জগতে টাকারই খেলা। টাকা যে কী পদার্থ, তাহা তুমি চেন বা না চেন, আমি বেশ চিনি। আর তুমি নিশ্চয় জানিয়ো, আমি নেহাত মূর্খ নহি, আপন লাভালাভ বেশ বুঝিতে পারি’।

শান্তনু চৌধুরী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক