মোহাম্মদ রফিক : চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পশ্চিম আলমপুর গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। পাশের মির্জাপুর ইউনিয়নের আংশিক এলাকাসহ এ গ্রামে বসবাস ২০০ পরিবারের। পাহাড়ঘেঁষা এ জনপদ আলোকিত করতে বছরখানেক আগে আধা কিলোমিটার দূর থেকে ১১ হাজার কিলোভোল্টের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন টেনেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বসানোর জন্য প্ল্যাটফর্মও প্রস্তুত করা আছে। হাটহাজারী বিদ্যুৎ বিভাগে পর্যাপ্ত ট্রান্সফরমারও মজুদ আছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, হাটহাজারী বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতা আর গাফিলতির কারণে বসানো হচ্ছে না ট্রান্সফরমার। অথচ পাশের পূর্ব আলমপুর, চারিয়া গ্রাম বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে প্রায় ৩ কোটি নতুন গ্রাহক বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছেন। দেশের ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। চর কুকড়ি-মুকড়ি থেকে দুর্গম পাহাড়ের কোথাও আর আঁধার নেই। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন পশ্চিম আলমপুর গ্রামে গিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের জন্য হাহাকারের দৃশ্য দেখা গেছে।
স্থানীয়দের অভিমত, যেখানে সাগরের তলদেশে ক্যাবল বিছিয়ে দুর্গম সন্দ্বীপে পৌঁছানো হয়েছে বিদ্যুৎ। সেখানে সন্ধ্যা নামার আগেই গভীর রাতের নীরবতা নেমে আসে পশ্চিম আলমপুর গ্রামে।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা মো. ইউনুচ মিয়া বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ যাবত আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। অথচ আমরা হাটহাজারী পৌরসভার বাসিন্দা। সরকারকে নিয়মিত কর, খাজনা দিই। আমাদের গ্রামে আছে মসজিদ, মাদ্রাসা। পাশ্ববর্তী চারিয়া গ্রামের কিছু অংশসহ পশ্চিম আলমপুর গ্রামে ২০০ পরিবার বসবাস করে। ১৫-২০ পরিবার সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। কিছু পরিবার আধা কিলোমিটার দূরে (পূর্বে) অবস্থিত ব্যারিস্টার আনিস খাল সংলগ্ন এলাকা থেকে ‘সার্ভিস তার’ টেনে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘরে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।’
বছরখানেক আগে নতুন ১১ হাজার কিলোভোল্ট ক্ষমতার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের শেষ প্রান্তে তথা পশ্চিম আলমপুর গ্রাম ঘেঁষে ট্রান্সফরমারের জন্য বসানো হয়েছে প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মের পাশে চারিয়া গ্রামের অংশে ‘আলিফ এগ্রো’ নামে একটি খামার গড়ে তোলার জন্য যৌথভাবে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন মোহাম্মদ হোসেন ও মো. জামাল। এদের মধ্যে মোহাম্মদ হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এক বছর আগে বিদ্যুৎ লাইন টেনেছে পিডিবি। শুধু একটিমাত্র ট্রান্সফরমার বসালেই আমাদের গ্রাম ফকফকা হয়ে যাবে। বিদ্যুতের অভাবে খামার গড়ে তুলতে পারছি না। ট্রান্সফরমার বসাতে পিডিবির লোকজন চরম গাফিলতি করছেন। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পরেও কেন যে ট্রান্সফরমারটি বসছে না তা বোধগম্য হচ্ছে না।’ একই কথা বললেন মো. জামালও।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পশ্চিম আলমপুর গ্রামটি পাহাড় টিলায় অবস্থিত। বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামের মাঝখান দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন টানা হলেও আশপাশের বাড়িঘর পড়ে আছে অন্ধকারে। এ গ্রামে আছে দুটি মাদ্রাসা। একটির নাম জিন্নুরাইন মাদ্রাসা, অন্যটি পশ্চিম আলমপুর নূরানী মাদ্রাসা। নেই কোন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্থানীয়রা জানান, এ গ্রামের শিশুরা দুই কিলোমিটার দূরের পথ হেঁটে চন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যায়। তিন কিলোমিটার দূরে আছে বেসরকারি আলমপুর জুনিয়র হাইস্কুল। বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকায় গড়ে উঠছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হাঁস-মুরগির খামার থাকলেও বিদ্যুৎ নেই।
নতুন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঘেঁষে গড়ে উঠা জিন্নুরাইন মাদ্রাসার শিক্ষক মিজানুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘পূর্বে আধা কিলোমিটার দূরে আনিস খাল এলাকা থেকে আনা ‘সার্ভিস তার’ দিয়ে মাদ্রাসা ও মসজিদে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশের কিছু বাড়িঘরেও এভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা আধা কিলোমিটার দূর থেকে বাঁশ-গাছ দিয়ে ‘সার্ভিস তার’ টেনে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন এসবের একটিও বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নয়। পুকুর বা পাহাড়ি লেকের ওপর দিয়ে টানা হয়েছে বিদ্যুতের অবৈধ লাইন। অথচ নতুন সঞ্চালন লাইনে ট্রান্সফরমার বসালেই বদলে যেত পশ্চিম আলমপুর ও পাশের চারিয়া গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান।
সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে ছোট একটি টং দোকান পরিচালনা করেন স্থানীয় নাসির সওদাগর নামে এক ব্যক্তি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এই দোকানে দেখা হয় মো. মহিউদ্দিনের। তিনি পশ্চিম আলমপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। দোকানের পাশে গড়ে ওঠা পাকা মসজিদে ইমামতি করেন মহিউদ্দিন। তিনি জানান, টং দোকানে বিক্রির জন্য আছে চাল, ডাল, তেল, কেরোসিনসহ নানা পণ্য। গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় কেরোসিন তেল বেশি বিক্রি হয় বলেও জানান মহিউদ্দিন।
সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা যায়, পশ্চিম আলমপুর গ্রাম ঘেঁষে পূর্ব দিকে চলে গেছে ব্যারিস্টার আনিস খাল। এই খালের স্লুইচ গেটের পাশে থাকা ১১ হাজার কেভি’র পুরনো লাইন থেকে বিভিন্ন টিলায় ৩২টি পিসি পিলার বসিয়ে নতুন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছে পশ্চিম আলমপুর গ্রামে। নতুন সঞ্চালন লাইনটির দূরত্ব হবে আধা কিলোমিটার। পশ্চিম আলমপুর গ্রামে নির্মাণাধীন মুরগির একটি খামারের পাশে বসানো হয়েছে ট্রান্সফরমারের প্ল্যাটফর্ম। এটির চারপাশ ঘিরে পাহাড়ের পাদদেশে আছে অসংখ্য বাড়িঘর।
পুরনো জরাজীর্ণ একটি গুদাম ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন বিলকিছ বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ নেই দেশ স্বাধীনের পর থেকে। একবছর আগে বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য পিডিবি নতুন পিলার বসিয়েছে। তার টেনেছে ৫-৬ মাস হলো। কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ তো দিচ্ছে না। কুপি ও হারিকেন জ্বালিয়ে রাতের কাজ সারতে হয়। প্রতিমাসে ৪-৫শ’ টাকার কেরোসিন তেল লাগে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী সামিনা বানু আজ বুধবার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সঞ্চালন লাইন স্থাপন এবং যাবতীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করা সত্ত্বেও হাটহাজারীর পশ্চিম আলম গ্রামে কেন ট্রান্সফমার বসানো হচ্ছে না, সে বিষয়ে আমি খোঁজ নেব।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পৌর প্রশাসক শাহিদুল আলম আজ বুধবার একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার বিষয়টি নিয়ে হাটহাজারীর বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় সময় ফোন পাচ্ছি। মজুদ থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম আলমপুর গ্রামে পিডিবি কেন ট্রান্সফরমার বসাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা হবে। বিষয়টি নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে কথা বলব। ঠিক কি সমস্যার কারণে ট্রান্সফরমারটি বসছে না, তা জানার চেষ্টা করব। দ্রুত পশ্চিম আলমপুর গ্রাম আলোকিত করতে তাদের অনুরোধ জানাব।’
পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (উত্তর) মাহফুজুল হক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘হাটহাজারীর ৯টি জায়গায় ট্রান্সফরমারের চাহিদা আছে। ইতোমধ্যে সন্দ্বীপ কলোনি ও চৌধুরী হাটের পশ্চিমে দুটি ট্রান্সফরমার বসানোর কাজ শেষ হয়েছে বলে জেনেছি। বাকি ৭টিও পর্যায়ক্রমে বসানো হবে।’
হাটহাজারীর পশ্চিম আলমপুরসহ আরও ছয়টি জায়গায় প্ল্যাটফর্ম বসানো হলেও ট্রান্সফরমার স্থাপনে কেন বিলম্ব হচ্ছে সে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেও জানান পিডিবি’র অন্যতম এ শীর্ষ কর্মকর্তা।
পশ্চিম আলমপুর গ্রামে ট্রান্সফরমার বসানো প্রসঙ্গে হাটহাজারী বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নেওয়াজ আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘হাটহাজারীতে ৯টি ট্রান্সফরমারের চাহিদা আছে। দুটি ইতোমধ্যে বসানো হয়েছে। পশ্চিম আলমপুরেরটা সময় লাগবে।’ তবে ট্রান্সফরমার মজুদ থাকা সত্ত্বেও কেন বিলম্ব হচ্ছে সে প্রশ্নের সদুত্তর দেননি তিনি।